Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চোরাই বিদ্যুতের ইজিবাইক

| প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


প্রচন্ড গরমে সারাদেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ ঘাটতি ৩০০০ মেগাওয়াট : প্রতিদিন ১০ লাখ ইজিবাইক ও মোটরচালিত রিকশা রিচার্জে লাগে ১০০০ মেগাওয়াট : দিনে সরকারের গচ্চা কমপক্ষে আড়াই কোটি টাকা

নূরুল ইসলাম : সারাদেশে সড়ক মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা সৃষ্টির জন্য হাইকোর্ট এসব যান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপরেও নিষিদ্ধ এ যানগুলো  চলছে চোরাই বিদ্যুতের চার্জ দিয়ে। প্রচন্ড গরমে যার প্রভাবে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে দুর্বিসহ যন্ত্রণা পোহাচ্ছে সারাদেশের মানুষ। বিআরটিএ-এর পরিচালক (অপারেশন) নাজমুল আলম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, শুধুমাত্র মোবাইল কোর্ট দিয়ে এসব যান বন্ধ করা যাবে না। সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ব্যাটারিচালিত যানগুলো পরিবেশের জন্য সরাসরি ক্ষতিকর। সঠিকভাবে এগুলোর ব্যাটারি রিচার্জ করা হয় না বলে সরকারের বাজেটে একটা বিরুপ প্রভাব পড়ে। এজন্য সরকারের উচিত এগুলো বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।    
সারাদেশে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের সংখ্যা কতো তার সঠিক হিসাব সরকারের কাছে নেই। ঢাকা সিএনজি অটোরিকশা শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ হানিফ খোকন জানান, সাধারণত ইজিবাইক সরাসরি কেউ আমদানী করে না। খুচরা যন্ত্রাংশ (সিকেটি)  আমদানী করে পরে বডি তৈরী করে  রাস্তায় নামানো হয়। এজন্য এর সঠিক হিসাব কারো জানা নেই। তিনি বলেন, সারাদেশের বিভাগীয় শহর, ৬৪ জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রাম থেকে গ্রামে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এসব যানবাহন নেই।
২০০৮ সালে মধ্যস্বত্বভোগী এক শ্রেণির মানুষ রিকশায় বৈদ্যুতিক মোটর ব্যবহারের মাধ্যমে ইঞ্জিনবিহীন হালকা যানবাহন হিসেবে রাস্তায় নামায়। ধীরে ধীরে তা বাড়তে বাড়তে প্রায় ১০ লাখে পৌঁছেছে। এর আগে ঢাকার বাইরে মফস্বল শহরগুলোতে স্যালো মেশিনের ইঞ্জিন দিয়ে নসিমন, ভটভটি, চাঁন্দের গাড়ি ইত্যাদি চলাচল শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশেই ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকে সয়লাব। ২০১২ সালের ১০ জানুয়ারি রিকশা-ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক বন্ধের দাবি ওঠে।  ডিএমপি কমিশনারের কাছে স্মারকলিপিও প্রদান করে তারা। এতে কাজ না হওয়ায় পরিষদের মালিকানাধীন রিকশাগুলোকে  ব্যাটারিচালিত রিকশায় পরিণত করার অনুমতি চেয়ে ২০১২ সালে ২৫ জানুয়ারি যোগাযোগ মন্ত্রী বরাবর আবেদন করে। রিকশা ভ্যান মালিক সংগ্রাম পরিষদের এক নেতা বলেন, সে সময় পুলিশ প্রশাসন থেকে বলা হয়েছিল, এসব গাড়ি কোথায় কোথায় তৈরি করা হয় এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে তাদের নাম ও ঠিকানা আমাদের কাছে দিলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। ইজিবাইক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন শো রুমের ঠিকানাসহ একটি তালিকা ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি পুলিশ প্রশাসনের কাছে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় নি।
সারাদেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনার প্রধান উপসর্গ হিসাবে সহজেই চিহ্নিত হয় এসব ইজিবাইক। এ কারণে মহাসড়কে এগুলো চলাচল নিষিদ্ধ করার জন্য পরিবহন মালিকরা সোচ্চার হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ অপচয়ের কারণ হিসাবেও এসব যানবাহন চিহ্নিত  করা হয়। ২০১৫ সালে সরকার দেশের ২২টি মহাসড়কে এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলায় মহাসড়কে এখনও দাপটের সাথে চলছে এসব যানবাহন। এরপর হাইকোর্ট এসব যান প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশও কার্যকর হয়নি।  সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৫ সালে মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষনার পর রাজধানীতে ইজিবাইকের চাপ বেড়ে যায়। মফস্বলের ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় ঢাকার এখন বেহাল অবস্থা। বর্তমানে ঢাকায় এর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় টোকেন বাণিজ্যের মধ্যেমে তেজগাঁও, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, গুলশান, মিরপুর, পল্লবী, খিলগাঁও, শ্যামপুর, তুরাগ, মোহাম্মদপুর, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, মুগদা, কামরাঙ্গীরচরসহ  রাজধানীর  বিভিন্ন এলাকায় অবাধে এসব অবৈধ যান চলাচল করছে।
জানা গেছে, ইজিবাইক ও ব্যটারিচালিক রিকশার ব্যাটারি রিচার্জ করতে চুরি করা বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। টাকা বাঁচাতে মালিকপক্ষ এ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। জানতে চাইলে কদমতলী এলাকার একজন ইজিবাইক মালিক বলেন, বৈধভাবে রিচার্জ করতে গেলে একদিনে কমপক্ষে চারশ’ টাকার বিদ্যুৎ লাগবে। এ কারণে আমরা গ্যারেজ থেকে চার্জ করাই। গ্যারেজগুলোতে বিদ্যুতের অবৈধ লাইন থাকে বলে রিচার্জ করতে অর্ধৈকেরও কম টাকা লাগে।
জানা গেছে, ঢাকাসহ সারাদেশেই চোরাই বিদ্যুতে ইজিবাইকের ব্যটারি রিচার্জ করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকেই ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যুৎ বিভাগের  দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তা টাকার বিনিময়ে গ্যারেজ মালিকদের এই সুযোগ করে দেন। রাজধানীর জুরাইন, মুরাদপুর, যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ডেমরা, শ্যামপুর, হাজারীবাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকাসহ বহু স্থানে এরকম গ্যারেজ আছে। এসব গ্যারেজের বিদ্যুতের সংযোগ অবৈধ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেইন লাইন থেকে সরাসরি সংযোগ লাগানো। ইজিবাইক মেকানিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন হয়। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে ৫ থেকে ৬ ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫-৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে দেশের প্রায় ১০ লাখ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার থেকে ১১শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হওয়ার কথা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম  ৫ টাকা করে হিসাবে ধরলে সারাদেশে ১০ লাখ ইজিবাইকের জন্য প্রতিদিন বিদ্যুতের খরচ  আড়াই কোটি টাকা। এ হিসাবে মানুষের ভোগান্তির কথা বাদ দিলে সরকার প্রতিদিন ইজিবাইকের কারণে আড়াই কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। একই সাথে এসব ইজিবাইক চার্জ দিতে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত খরচ হচ্ছে। যা গরমে লোডশেডিংয়ের প্রধান কারণ। বিদ্যুত বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েকদিন তীব্র গরমে সারাদেশে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার মেগাওয়াট।   
জানা গেছে, ঢাকায় নিষিদ্ধ ইজিবাইক চলাচলের নেপথ্যে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশ। তাদের সাথে যুক্ত বিদ্যুৎ বিভাগের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ চুরি করে সাধারণ মানুষ লোডশেডিংয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করলেও লাভবান হচ্ছে ইজিবাইকের মালিক, দালালচক্র, বিদ্যুতের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ক্ষমতাসীন নেতারা। রাজধানীর কদমতলী থানার দনিয়া এলাকায় পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার চাচাতো ভাই পরিচয়ে হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা নামানো হয়েছে। এসব রিকশার কারণে শনিরআখড়া থেকে দোলাইপাড়, মুরাদপুর, জুরাইনের রাস্তায় দিনরাত যানজট লেগে থাকে। কদমতলী থানার কমিউনিটি পুলিশের নেতা ওই ব্যক্তি পুরো কদমতলী থানা এলাকার মানুষকে জিম্মি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে বলে বহু মানুষের অভিযোগ। পুলিশ তার দাপটের কাছে অসহায়। এমনিভাবে রাজধানীর অন্যান্য থানা এলাকাগুলোতেও  ইজিবাইক চলছে চোরাই বিদ্যুতে।  ভুক্তভোগিরা জানান, ঢাকার মিরপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, তুরাগ, খিলক্ষেত, উত্তরখান, বাড্ডা এলাকার চিত্র প্রায় একই রকম। তবে অনেকের মতে, কদমতলীর মতো এতোটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ডিএমপির অন্য কোনো থানায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রিকশা ও ইজিবাইকগুলো যে শুধু বিদ্যুতের অপচয় করছে তা নয়, এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। ইজিবাইকের কারণে রাজধানীসহ সারাদেশেই দুর্ঘটনার হার বেড়ে গেছে। এসব বিষয়ে বিআরটিএ-এর পরিচালক (অপারেশন) নাজমুল আলম বলেন, ইজিবাইক নিয়ে ইতোমধ্যে বিআরটিএ-তে মিটিং সিটিং হয়েছে। এগুলোর কারণে বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। আমার জানা মতে, অবৈধ এসব যানের তালিকা তৈরী করা হচ্ছে যাতে ভবিষ্যতে এগুলোর সংখ্যা না বাড়ে। তিনি বলেন, আমাদের ৫টি মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। প্রতিদিনই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অবৈধ এসব যান ধংসকরাসহ মালিকের জেল জরিমনা করা হচ্ছে।



 

Show all comments
  • কিরণ ২৪ মে, ২০১৭, ৩:৪৭ এএম says : 0
    বিদ্যুতের ইজিবাইক বন্ধ করে সোলারের ইজিবাইক চালানো যেতে পারে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইজিবাইক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ