Inqilab Logo

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

চোরাই বিদ্যুতে চলছে ইজিবাইক

কদমতলীতে ৩ হাজারের বেশি ইজিবাইক ও রিকশার নেপথ্যে প্রভাবশালীরা

প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিশেষ সংবাদদাতা : নিষিদ্ধ তবুও দেদারছে চলছে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। ঢাকায় এসব চলাচলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আছে কিন্তু সেই আইন কেউ মানে না। বরং স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও পুলিশকে ম্যানেজ করে হাজার হাজার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চলছে চোরাই বিদ্যুৎ দিয়ে। এতে করে বিদ্যুৎ বিভাগের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা লাভবান হচ্ছে। সারাদেশে পাঁচ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের অন্যতম প্রধান কারণ এই সব ব্যাটারিচালিত যান। দুর্ঘটনা কমাতে সারাদেশের মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত এসব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। গত বছর এই আদেশ জারি হওয়ার পর কিছুদিন এসব চলাচল বন্ধ ছিল। এরপর আবার আগের মতোই চলাচল শুরু হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে আকস্মিক অভিযান চালিয়ে মহাসড়কে চলাচলরত ২০টি ইজিবাইকের ব্যাটারি জব্দ করেছেন। একই সাথে মন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) দেশব্যাপী অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশার দাপট আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে এসব নিষিদ্ধ যানবাহন। ঢাকার কদমতলী, শ্যামপুর, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, পল্লবী, শাহআলী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, তুরাগ, বাড্ডা, রামপুরা, সবুজবাগ এলাকায় এসব যানবাহন প্রকাশ্যেই চলাচল করে। এর বাইরে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-মাওয়া, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে চলাচল তো আছেই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকাতেই আছে তিন হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও রিকশা। স্থানীয় সরকারদলীয় প্রভাবশালী নেতা ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে এসব নিষিদ্ধ যান। আলাপকালে ভুক্তভোগীরা জানান, ব্যাটারিচালিত যানের ভিড় এতোটাই বেড়েছে যে এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটাই যায় না। কদমতলীর দনিয়া এলাকায় গত ২৮ মার্চ ইজিবাইক দুর্ঘটনায় যুথী নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মতিঝিল মডেল কলেজের ছাত্রী যুথীর মৃত্যুর পরেও কমেনি ইজিবাইকের দাপট। প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয় নি। বরং ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে। বেলায়েত নামে এক ব্যবসায়ী জানান, যুথীর মৃত্যুর দুদিনের মাথায় ইজিবাইকের ধাক্কায় তার হাত ভেঙ্গে যায়। সেই হাত এখনো সারে নি। শনির আখড়া বাজারের এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে দনিয়া এলাকার রাস্তা দিয়ে এখন হাঁটাই যায় না। সকালে বাচ্চাকে নিয়ে স্কুল যেতে গিয়ে পড়তে হয় মহা বিপাকে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। এমনকি এসব যানবাহনের ভিড়ে শনিরআখড়া বাজারেও প্রবেশ করা যায় না। এ কারণে বাজারের অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানান সেখানকার ব্যবসায়ীরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কদমতলী থানা এলাকায় ইজিবাইকের বেশ কয়েকটি রুটচালু আছে। এর মধ্যে রায়েরবাগ ও মোহাম্মদবাগ রুটে চলাচল করে কমপক্ষে দুই হাজার ইজিবাইক ও রিকশা। রায়েরবাগের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে ডিউক ও সেলিম এবং মোহাম্মদবাগে নিয়ন্ত্রণ করে লিটন ও তার দুই ভাই। প্রতিদিন এখানে ইজিবাইক প্রতি ৩০ টাকা রিকশা প্রতি ২০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হয়। এলাকাবাসীর হিসাব মতে, শুধু এই দুই রুট থেকেই মাসে তিন লাখ টাকার বেশি চাঁদা ওঠে। থানা পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা ওই টাকার মোটা অংশের ভাগ পায়। এছাড়া বড়ইতলা থেকে বিক্রমপুর প্লাজা, পোস্তগোলা থেকে পাগলা, ধোলাইরপাড় থেকে শনিরআখড়া, জুরাইন মেইন রাস্তা থেকে মুরাদপুর হয়ে কোদারবাজার পর্যন্ত আছে একটি করে রুট। জানা গেছে, মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের এই রুট নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বডিগার্ড মাসুম। প্রতিটি ইজিবাইক থেকে প্রতিদিন দেড়শ’ টাকা করে চাঁদা তোলে মাসুম। নাম পরিচয় গোপন রেখে একজন ইজিবাইক চালক জানান, কদমতলী থানা পুলিশ, ও মেইনরোডের ট্রাফিক পুলিশের নাম করে এই চাঁদা তোলা হয়। কিন্তু কে কতো পায় সেটা তো আমরা জানি না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তিন হাজারেরও বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশার ব্যাটারির চার্জ দেয়ার জন্য মুরাদপুর এলাকাতেই আছে কয়েকটি গ্যারেজ। যেগুলোতে অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ নেয়া আছে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে। এর মধ্যে মুরাদপুর মাদ্রাসা রোডের আবুল গ্যারেজ, কোদারবাজারের কালামের গ্যারেজ এবং মাদ্রাসা রোডের মাথায় রাস্তার দুই পাশের কয়েকটি দোকানেও রয়েছে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ। সেখানেও চার্জ দেয়া হয়। অন্যদিকে, ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরী করা হয় পাটেরবাগ, দনিয়া, রায়েরবাগ, ডেমরা, কাজলা, ভাঙ্গাপ্রেসসহ বিভিন্ন এলাকায়। দনিয়া এলাকায় রুস্তম নামে এক রিকশা শ্রমিক নেতা আছে তার প্রত্যক্ষ ইন্ধনে হু হু করে বাড়ছে ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা। একজন ভুক্তভোগিরা বলেন, সরকারের আইন অমান্য করে সুবিধাভোগি এই নেতা নিজের পকেট ভারি করছেন কিন্তু মানুষের অসুবিধার কথা তারা মোটেও ভাবে না। একটা এলাকায় শত শত রিকশা চলাচল করলে কি অবস্থা হয় তা ওই সব নেতা জানেন না। আরেকজন ভুক্তভোগি বলেন, দনিয়া এলাকার অবস্থা দেখে মনে হয় না এটা রাজধানী শহর। মনে হয় কোনো মফস্বল শহরে বাস করছি আমরা। এসব যানবাহনের কারণে মানুষ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করছে। রাস্তায় চলাচলের মতো অবস্থা নেই আরও কতো অসুবিধা হচ্ছে তার খবর কেউ রাখে না।  
ঢাকার মিরপুর, সবুজবাগ, রামপুরা, তুরাগ, খিলক্ষেত, উত্তরখান, বাড্ডা এলাকার চিত্র প্রায় একই রকম। তবে অনেকের মতে, কদমতলীর মতো এতোটা বিশৃঙ্খল অবস্থা ডিএমপির অন্য কোনো থানায় নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রিকশা ও ইজিবাইকগুলো যে শুধু বিদ্যুতের অপচয় করছে তা নয়, এগুলো পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত একটি ইজিবাইকের জন্য চার থেকে পাঁচটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি প্রয়োজন। আর প্রতি সেট ব্যাটারি চার্জের জন্য গড়ে ৮০০ থেকে ১১০০ ওয়াট হিসেবে পাঁচ থেকে ছয় ইউনিট (দিনে বা রাতে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা) বিদ্যুৎ খরচ হয়। সে হিসেবে দেশের পাঁচ লাখের বেশি ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জের জন্য জাতীয় গ্রিড থেকে প্রতিদিন অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। আর চুরি করে ও লুকিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে তা রিচার্জ করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন করে ইজিবাইক আমদানি বন্ধ ও পুরনোগুলো পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এমনকি মহাসড়কগুলোতে এই যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না।
অন্যদিকে, সড়ক-মহাসড়কে অবৈধ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) দেশব্যাপী অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ অননুমোদিত যানবাহনের বিরুদ্ধে বিআরটিএ’র অভিযান দেখতে গিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। এ সময় এ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বেশকিছু ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ব্যাটারি জব্দ করা হয়। সেতুমন্ত্রী বলেন, অননুমোদিত এবং নন-মোটরাইজড (অযান্ত্রিক) যানবাহন ব্যাপকহারে সড়ক-মহাসড়কে চলাচল করছে। সর্বাত্মক অভিযানের মধ্যদিয়ে এসব যানবাহনের চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ জন্য বিআরটিএ’র মোবাইল কোর্টের কার্যক্রম জোরদার করা হবে। ব্যাটারিচালিত রিকশা একদিকে দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে অপরদিকে বিদ্যুতের অপচয় ঘটাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ অন্যান্য অননুমোদিত যানবাহন বন্ধে হাইকোর্টেরও নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলেরও সিদ্ধান্ত রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চোরাই বিদ্যুতে চলছে ইজিবাইক
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ