Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ডায়াবেটিক রোগীর রোযা রাখা

| প্রকাশের সময় : ১৯ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

পৃথিবীতে প্রায় ২০০ কোটি মুসলমান আছে যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬%। বর্তমানে পৃথিবীতে ডায়বেটিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ৪১৫ মিলিয়ন। পৃথিবীর মোট প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের ৩৬% ডায়াবেটিসে ভুগছেন। সে হিসেবে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি রমযান মাসে ৯-১২ কোটি ডায়াবেটিক রোগী রোযা রাখছেন। একটি গুরুত্বর্পূণ গবেষনায় দেখা গেছে যে, টাইপ-১ ডায়াবেটিক রোগীদের ৪৩% এবং টাইপ২ ডায়াবেটিক রোগীদের ৭৯% রমযান মাসে রোযা রাখেন।
রোযার সময় একজন মানুষকে ভোররাত হতে সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান ও মৌসুম ভেদে এ সময়কাল ১৪ ঘন্টা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২৩ ঘন্টা পর্যন্ত হতে পারে। আমাদের দেশে সেহরী ও ইফতারের মধ্যবর্তী সময় সর্বোচ্চ ১৭ ঘন্টা হতে পারে। এ দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিক রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কী না তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়বেটিস বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মত ভাবে মতামত দিয়েছেন যে, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিক রোগীর পক্ষে রোযা রাখা ক্ষতিকর হবে। কুরআন শরীফেও রোগাক্রান্তদের রোযা রাখা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে ( সুরা আল বাকারা ঃ আয়াত ১৮৩- ১৮৫) আর অন্য যে কোন ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়বেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহনের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিক রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে। তারপরও কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী রমযান মাসে রোযা রাখতে জেদ করেন। কোন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ডায়বেটিক রোগীকে রোযা রাখার পরামর্শ দিবেন না। কিন্তু কোন ডায়বেটিক রোগী যদি ধর্মীয় প্রচন্ড আগ্রহের কারনে রোযা রাখতে চান তবে তাকে নিষেধ করাও কারো পক্ষে সম্ভব না। এখানে আমরা ডায়াবেটিক রোগীর রোযা রাখার কারণে যে সব সমস্যা হতে পারে এবং তা থেকে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার পদ্ধতি আলোচনা করব।
রোযা রাখার সময় ডায়বেটিক রোগীর ঝুকিঁ সমূহঃ
রক্তের গøুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া ( হাইপোগøাইসেমিয়া)
খাদ্য গ্রহণে অনেকক্ষণ যাবৎ বিরত থাকলে রক্তের গøুকোজের পরিমান কমতে থাকে। রক্তে গøুকোজের পরিমান ডায়বেটিক রোগীর রোযা রাখার সময় এতটাই কমে যেতে পারে যে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হতে পারে। টাইপ ১ ডায়বেটিক রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হাইপোগøাইসেমিয়া হবার সম্ভবনা ৪.৭ গুন এবং টাইপ২ ডায়বেটিকের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুন বেশি।
রক্তে গøুকোজের পরিমান বেড়ে যাওয়া (হাইপারগøাইসেমিয়া)
রোযা রাখার কারণে টাইপ ১ ও টাইপ ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গøুকোজের মাত্রা বেড়ে যাবার কিছুটা ঝুকিঁ থাকে। তবে টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাতœক হতে পারে। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে এ থেকে জীবন নাশের ঘটনাও ঘটতে পারে।
ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিসঃ
টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গøুকোজ মারাতœক ভাবে বেড়ে যাওয়া বা কিটোনবডি বেড়ে যাবার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থ হতে পারে। বিশেষ করে যাদের রক্তের গøুকোজ রোযা শুরুর আগে সঠিক মাত্রায় ছিল না।
পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজমঃ
দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানি শূন্যতা ( ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। আর গরম ও বেশি আদ্র আবহাওয়ায় পানি শূন্যতা আরো প্রকট হতে পারে। যাদেরকে রোযা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয়। তাদেরও পানি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া, রক্তে বেশি মাত্রায় গøুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাবার হার অনেক বেড়ে যায়। এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাড়াঁলে মাথা ঘুরতে পারে। বিশেষত যাদের ডায়াবেটিসের কারনে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তাদের এ সময় সহসা জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া,আঘাত প্রাপ্ত হওয়া, হাড় ভেঙ্গে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে পারে। দেহের পানি শূন্যতার কারণে রক্ত জমাট থ্রম্বোসিস হতে চোখের রেটিনার কেন্দ্রীয় শিরা বন্ধ হয়ে দৃষ্টি শক্তি হারাবার ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে।
ব্যবস্থাপনাঃ
ডায়াবেটিক রোগীর রোযা রাখা একান্তভাবেই তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, যা তার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মœক ঝুঁিক তৈরি করতে পারে এবং তার চিকিৎসকের জন্যও তা চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি ডায়াবেটিক রোগীই রোযা রেখে কম বেশি ঝুকিঁর আওতায় চলে আসেন।
এক্ষেত্রে করনীয় বিষয় সমূহ হল ঃ
প্রত্যেক রোযাদার ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্রসহ বিবেচনা করতে হবে।
ঘন ঘন রক্তের গøুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। প্রতিদিন বেশ ক’বার (কম পক্ষে তিন বার) রক্তে গøুকোজের মাত্রা দেখতে হবে। শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গøুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ ১ ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সাথে রক্তের গøুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতই রাখার চেষ্টা করতে হবে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। গবেষনায় দেখা যায় ২০%-২৫% ডায়াবেটিক রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহন করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা এসব হজম হতে সময় লাগবে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীর ইফতারের পর পরই যত দ্রæত সম্ভব রক্তে গøুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করতে হবে। সেজন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহরীর সময় খেতে হবে। আর ইফতারীতে সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরীর খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হবার ঠিক পূর্বে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্জনীয়।
শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকান্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভাল। এতে করে হাইপোগøাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না। আর তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রম হিসেবে গন্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী (বিশেষত টাইপ১) যাদের রক্তের গøুকোজ ঠিক মত রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগøাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাতœক হয়।
প্রতিটি ডায়বেটিক রোযাদারকে একথাটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগøাইসেমিয়ার কোন লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তার পর যতটা সম্ভব দ্রæততর সময়ের মধ্যে গøুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোন খাদ্য/সরবত ইত্যাদি যে কোন একটি খেয়ে নিতে হবে। যাদের হাইপোগøাইসেমিয়া হয়েছে, তারা তো খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবে। আর যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক বড়ধড়ফরানি, মাথা ফাঁকা ফাকাঁ লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষন দেখা দিবে। তখন হাইপোগøাইসেমিয়া ( রক্তের গøুকোজ এসময় সাধারনত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হয়েছে ধরে নিতে হবে। আবার দিন শুরুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যদি রক্তের গøুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/ লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেয়া জরুরী। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইলইউরিয়া মেগিøটিনইড জাতীয় ঔষধ গ্রহন করছেন তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনা বেশি। আবার রক্তের গøুকোজ ১৬৭ মিলিমোল/ লিটার এর বেশি হলেও রোযা রাখা সম্ভব হবে না।
প্রাক রমযান মূল্যায়নঃ যেসব ডায়াবেটিক রোগী সব ঝুকিঁর কথা জেনেও রোযা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তাদেরকে রোযা শুরুর কমপক্ষে ১ মাস আগে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে নিতে হবে। এর মধ্যে আছে খালি পেটে ও খাবার ২ ঘন্টা পর (মোট ৬ বার) রক্তের গøুকোজ, খালি পেটে রক্তের লিপিড, লিভার কিডনী ও হৃদপিন্ডের কার্যকারিতার পরীক্ষা, এবং এইচবিএ১সি ইত্যাদি পরীক্ষা করে নিতে হবে।
সকলকেই তার নিজের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসগণ এক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করবেন।
ষ ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
কমফোর্ট ডক্টর’স চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীনরোড, ঢাকা
মোবাঃ ০১৭৩১৯৫৬০৩৩, ০১৫৫২৪৬৮৩৭৭, ০১৯১৯০০০০২২



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন