ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
মো. ওসমান গনি : জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সামগ্রীর বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমদানিকারকরা যে যার মতো করে মূল্য নির্ধারণ করে বিক্রি করছে। আর সর্বস্বান্ত হচ্ছে ভুক্তভোগীরা। আবার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের মুনাফা। তার ওপর মানহীন ও ঝুকিঁপূর্ণ চিকিৎসা পণ্য আমদানি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বাংলাদেশের বাজারে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের সার্জিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতি (মেডিকেল ডিভাইস) বিক্রি হয়। এসব চিকিৎসা সামগ্রীর ওপর ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সূত্রমতে, রোগ নির্ণয়, প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ সারাতে ব্যবহৃত প্রায় সাড়ে চার হাজারেরও বেশি আইটেমের চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বিক্রি হচ্ছে। জানাগেছে, কয়েকটি দেশীয় কোম্পানি সামান্য পরিমান চিকিৎসা সামগ্রী উৎপাদন করলেও বেশির ভাগ চিকিৎসা সামগ্রী বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর এসব পণ্য আমদানিকারকদের পোয়া বারো। আমদানিকারকরা বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নাভিশ্বাস উঠে ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনদের। চিকিৎসা সামগ্রীর গাঁয়ে মূল্য লেখা না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতেও কয়েকগুণ বেশি মূল্য দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অজানা মূল্যে পণ্য কিনতে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্তও হচ্ছেন। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকার এসব চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি ও বিক্রিতে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সরকারও মোটা অঙ্কের রাজস্বথেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সূত্রমতে, সাধারণত যে সব চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি করতে হয় তা হলো- হার্টের বøক নিয়ন্ত্রণ করতে হার্ট রিং, হার্টভাল্ব, পেসমেকার, হার্ট, আর্টিফেসিয়াল প্রসথেসিস, আর্টিফিয়িসাল গ্রাফট, অক্সিজেন, অক্সিমিটার, নেবুলাইজার, মনিটরিং এয়ার, গ্যাস, লিনিয়ার এক্সিলেরেটর, ফ্লুয়িড, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফ, ডায়ালাইসিস, ডায়ালাইজার, ডায়াথার্মি, বায়াপসি, বায়োমাইক্রোস্কোপ, ব্যান্ডেজ, বেলুন, বেøড বোন, ক্যাথেটার, ক্যানুলা, ওয়্যার, ভেন্টিলেটরমেশিন, এক্সরে, সিটি স্ক্যান ও আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদি রয়েছে। সরকারিভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় আমদানিকৃত এসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি বাজারে যুক্তিসঙ্গত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। স¤প্রতি হার্টের রিংয়ের মূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্যরা দেশের মেডিকেল ডিভাইসের বাজারের বিশেষ করে জীবনরক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইসের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এদিকে দেশের বিভিন্ন বাজারে জীবনরক্ষাকারী এসব পণ্যের মান নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ। এসব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বার্থ হাসিল করছেন কিছু অসাধু আমদানিকারক। সুযোগ বুঝে এসব আমদানিকারক নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী আমদানি করছেন এবং তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছেন। আর এসব অনৈতিক কাজে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকদের। তারা মোটা অঙ্কের কমিশনের বিনিময়ে এসব জিবনরক্ষাকারী পণ্যের বৈধতা দিচ্ছেন। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভুক্তভোগী রোগীরা। গত বছর ১৩ নভেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের কাছে ওষুধ, মেডিকেল ডিভাইস এবং ডায়াগনস্টিক রিয়েজেন্ট ছাড়করণের বিষয়ে একটি চিঠিও দেন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান। প্রশাসনের এ পদক্ষেপ মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। তারা আমদানি নীতির কথা বলে মেডিকেল সামগ্রীগুলোর কোনো ধরনের নিবন্ধন ছাড়াই ব্যবসা কার্যক্রম চালাতে চান। যে দাবি আদায়ে ৬ ডিসেম্বর থেকে টানা তিনদিন ধর্মঘট পালন করেছে বাংলাদেশ মেডিকেল ইনস্ট্রুম্যান্টস অ্যান্ড হসপিটাল এবং ইকুইপম্যান্ট ডিলার্স অ্যান্ড ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমআইএইচ এবং ইডিএমএ)। শুল্ক গোয়েন্দা মহাপরিচালককে লেখা চিঠিতে মেজর জেনারেল মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্ট অনুযায়ী যে কোনো ওষুধ বা মেডিকেল ডিভাইস আমদানিতে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নেওয়া আবশ্যক। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই মেডিকেল ডিভাইস আমদানির জন্য ভিন্ন এইচএস কোড ব্যবহার করে বিদেশ থেকে পণ্য আনছেন আমদানিকারকরা। ফলে দেশে মানবহির্ভূত ওষুধ ও মেডিকেল ডিভাইস ছড়িয়ে পড়ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি। জানা গেছে, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গøাভস, সুঁই, সিরিঞ্জ, ইনজেকশন, সুতার ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো ধরনের পরীক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। ফলে চরম ঝুঁকিতে সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে চিকিৎসা সেবা। বেশিরভাগ মেডিকেল ডিভাইস বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও তার মান সম্পর্কেঅবগত করা হয় না কর্তৃপক্ষকে। এতে রোগীর জীবন দিন দিন হুমকির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিরাপদ চিকিৎসা পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ব্যবহারের ফলে ঘটতে পারে অসুস্থতা, ক্ষত, এমনকি মৃত্যু। আর এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনসহ আরো কিছু বিদ্যুৎনির্ভর যন্ত্রপাতি আছে, যেগুলোর মান সম্পর্কে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েরও নেই কোনো আইন। সুবিধাভোগী চিকিৎসকরাও অসৎ উদ্দেশ্যে ভালো মানের কথা বলে মানহীন সামগ্রী রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করে থাকেন। এসব যন্ত্রপাতির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মান নিয়ন্ত্রণ ও যাচাইয়ের শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সামগ্রীগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা আরো বেশি জরুরি বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, একজন রোগী প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসার সময় নির্ভর থাকেন একজন চিকিৎসকের ওপর। যখন ইনজেকশনের সুঁই কিংবা সুতা ব্যবহার করা হয়, তখন কর্তৃপক্ষও জানে না সেগুলো ভালো, না খারাপ। এর পরও সেগুলো রোগ নির্ণয়, রোগ প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণ, চিকিৎসা ও রোগ সারাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সূত্র জানায়, ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছে, যেখানে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দেশে উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করার ক্ষেত্রে। কিন্তু আমদানিকারক ও উৎপাদকরা দেশে ব্যবহৃত প্রায় ১৮০০ চিকিৎসা-সামগ্রীর মধ্যে প্রায় ১০০টি পণ্যের নিবন্ধন করিয়েছেন। স¤প্রতি চার হাজার চিকিৎসা পণ্য কিংবা ডিভাইসের তালিকা করেছে এবং সেসব নিবন্ধনের জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজারে যেসব চিকিৎসা-সামগ্রী পাওয়া যায় সে সম্পর্কে কোনো রোগীর পক্ষে তার মানযাচাই করা সম্ভব নয়। কারণ মান নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রমাণপত্র রাখা হয় না। তবে এসব ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন অপারেশনের রোগীরা। ২০১৫ সালের একটি স্বাস্থ্য বুলেটিনে পাওয়া গেছে, এক বছরে দুই হাজার ৫১৪ জন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট থেকে হার্ট অপারেশন করেছেন। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘কিছু জিনিস আছে যেগুলোকে আমরা ওষুধ হিসেবে গণ্য করি। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু গাইডলাইন করা হয়েছে, যেখানে অনুমোদিত কোম্পানিগুলো মেডিকেল ডিভাইসের স্যাম্পল আমাদের ল্যাবে মান নিয়ন্ত্রণের পর বাজারজাত করে থাকে। এসবের মান নিয়ন্ত্রণে দুটি ল্যাব আছে। একটি ঢাকার মহাখালীতে আর অন্যটি চট্টগ্রামে। বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে মানুষের জন্য ৭টি ও ভেটেরিনারি ওষুধের ক্ষেত্রে ১৪টি দেশের অনুমোদন দেওয়া আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসিবিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফের মতে, চিকিৎসা পণ্যের মান নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই। প্রতিটি পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবহৃত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এটা রোগীর জন্য মারাত্মক ঝুকিঁপূর্ণ। তিনি বলেন, অপারেশনের পর রোগীর ইনফেকশন হতে পারে। তিনি বলেন, আমদানির ক্ষেত্রে আগে ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে কোনটা মেডিকেল ডিভাইস আর কোনটা না। এরপর সে বিষয়ে নিবন্ধন পদক্ষেপ নিতে হবে। বিএমআইএইচ এবং ইডিএমএর ঢাকা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মতে, ন্যয়সঙ্গতভাবে দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছি। দ্রæত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মেডিকেল ডিভাইসেস রেজিস্ট্রেশনের প্রস্তাবিত গাইড লাইন স্থগিত করতে হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর দেরিতে হলেও যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে সাধুবাদ জানাই। যদিও সেটি মন্দের ভালো। এসব জীবন রক্ষাকারী আবার জীবন হরণকারীও। তাই এসব পণ্য আমদানিতে সংশ্লিষ্টদের নজরদারি আরো বাড়ানো উচিত। তিনি বলেন, দেশীয় কয়েকটি কোম্পানিও মেডিকেল ডিভাইস উৎপাদন শুরু করেছে। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার আমদানিকৃত মেডিকেল ডিভাইস সার্জিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্যাল ডিভাইস বিক্রি হলেও এগুলোর গুণগত মান ও যুক্তিসঙ্গত দাম নির্ধারণ না হওয়াটা দুঃখজনক। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান এর মতে, আগে দেশের আমদানি করা মেডিকেল ডিভাইসের মান দেখার মতো কোনো সংস্থা ছিল না। তাই মানসম্মত মেডিকেল ডিভাইস ব্যবহার ও সাধারণ মানুষকে নির্দেশনাপ্রদানের লক্ষ্যে অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। জীবনরক্ষাকারী মেডিকেল ডিভাইস ব্যবহারের ব্যাপারেও গাইডলাইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। তার মতে, ১৭ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শে করোনারি স্ট্যান্টের যুক্তিসঙ্গত দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে তাদের কার্যক্রম শুধু হার্টের রিংয়েই নয়, জীবনরক্ষাকারীসহ সকল মেডিকেল ডিভাইসের যুক্তিসঙ্গত মূল্য নির্ধারণে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যেই জীবনরক্ষাকারী ডিভাইসের একটি তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।