Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চিনির সিন্ডিকেট বেপরোয়া

| প্রকাশের সময় : ৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আন্তর্জাতিক দর কেজি ৪১.৩০ টাকা, দেশের বাজারে ৭৫-৮০ টাকা : গতবছর এ সময়ের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধি ৩২ শতাংশ : কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে শত শত কোটি টাকা হাতানোর পাঁয়তারা
শফিউল আলম : বাজারে হঠাৎ করে চিনির দাম বেড়েই চলেছে। কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই চিনির পাইকারি ও খুচরা উভয় দর এখন ঊর্ধ্বমুখী। গতকাল রোববার খুচরা বাজারে চিনির দাম কেজিতে আরও ৫-৮ টাকা বেড়ে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৭৮ টাকা এমনকি ৮০ টাকা পর্যন্ত। পাইকারি বাজারে দর উঠেছে কেজি গড়ে ৫৮-৬০ টাকায়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে এ মুহূর্তে চিনির দর পড়ে কেজি ৪১.৩০ টাকা। ঢাকা, চট্টগ্রামভিক্তিক গুদামের মজুদসহ আমদানি খালাস প্রক্রিয়া মিলে দেশে বর্তমানে অন্তত ৪ লাখ মেট্রিক টন চিনি থাকার কথা। যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি। তা সত্তে¡ও বাড়ছে চিনির মূল্য। এখনই সরকারের পক্ষ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে লাগাম টেনে ধরা না হলে মাহে রমজান পর্যন্ত চিনির মূল্য কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠিত ভোক্তা সাধারণ। টিসিবি সূত্রও গত গত ২ মে থেকে চিনির মূল্যবৃদ্ধির সত্যতা স্বীকার করে দর বেড়ে গতকাল কেজি ৬৭ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানায়। যদিও তা আরও বেশি দরে বিকিকিনি হচ্ছে। আর গতবছরের এ সময়ের তুলনায় (৭ মে ২০১৬ইং) চিনির গড়মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ বেড়ে গেছে। তখন দর ছিল কেজি ৫০-৫৪ টাকা।      
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, আসন্ন পবিত্র শবেবরাত, রমজান ও ঈদ পর্যন্ত সমগ্র দেশে চিনির বাড়তি চাহিদাকে সামনে রেখে বিশেষত রোজায় অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য হিসেবে পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে অসৎ চিনি-সিন্ডিকেট। এর নেপথ্যে সক্রিয় রয়েছে দেশের প্রধান পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার খাতুনগঞ্জে অবস্থিত চট্টগ্রাম ও ঢাকাকেন্দ্রিক কতিপয় চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধন মিল মালিক, এজেন্ট, পাইকার-আড়তদার ও পুরনো ডিও কারবারিরা। সংঘবদ্ধ মজুদদার ও মুনাফাখোর চক্রটি বিভিন্ন স্থানে গুদামে সরিয়ে নিয়েছে সিংহভাগ আমদানিকৃত চিনির চালান। সেই সাথে রোজার আগে চিনির চাহিদা সামাল দিতে যেখানে সবক’টি রিফাইন্ড মিল একযোগে চালু থাকাই যুক্তিযুক্ত সেখানে, ‘সংস্কারের’ অজুহাতে অধিকাংশ কারখানা বর্তমানে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
এ অবস্থায় চলমান কৃত্রিম সঙ্কটের কারণেই গত দু’দিনে পাইকারি বাজারে চিনির দর বেড়ে গেছে মণপ্রতি (৩৭ কেজি) ৭৫ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। বেপরোয়া মুনাফা লুটার হীন মানসে চিনি-সিন্ডিকেট দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজার কব্জা ও নিয়ন্ত্রণ করছে গত দুই সপ্তাহ ধরে। গতকাল চাক্তাই খাতুনগঞ্জের বড় বড় পাইকারি দোকানে গত সপ্তাহের চেয়ে কম পরিমাণে চিনি চোখে পড়েছে। যা কৃত্রিম সঙ্কটের আলামত বহন করে। পাইকারি দরে গত দু’দিনে এস আলম ব্রান্ডের চিনি বিক্রি হয়েছে প্রতিমণ ২০৪০ টাকা থেকে ২ হাজার ১৮০ টাকায়। সিটি গ্রæপের চিনি ২ হাজার ১৩২ টাকা, মেঘনা গ্রæপের চিনি ২ হাজার ১১০ টাকা। সেই হিসাবে প্রতিকেজি চিনির পাইকারি দর পড়ছে ৫৫ টাকা থেকে ৫৮ টাকা। অথচ মিল মালিক-আমদানিকারক-পাইকারদের যোগসাজশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটানোর কারণে তাদের অনুসরণ করে সারাদেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা আরও এক ধাপ এগিয়ে যথেচ্ছ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। খুচরা বাজারে এখন চিনি বেচাকেনা হচ্ছে কেজি ৭৫ থেকে ৭৮ টাকায়, এমনকি ৮০ টাকা পর্যন্ত। দাম আরও বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে। গত ৪ মে (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, দেশের বৃহত্তম পাইকারি ও ইন্ডেন্টিং বাজার চাক্তাই খাতুনগঞ্জভিত্তিক নিত্যপণ্যের আমদানিকারক-ব্যবসায়ী, ভোক্তাদের যৌথ সভায় কেজিপ্রতি চিনির দাম পাইকারি ৫৮ থেকে ৬০ টাকা এবং খুচরা ৬২ থেকে ৬৩ টাকা দর ‘নির্ধারণ’ করে দেয়া হয় মূলত ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবমাফিক। যা পরদিন ৫ মে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সেই ‘বেঁধে দেয়া’ মূল্য ছাড়িয়ে গেলেও বাজার তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের কোনো খবর নেই।   
দেশে চিনির চাহিদা ধরা হয় বছরে সাড়ে ১৩ লাখ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে রোজার মাসজুড়ে চিনির চাহিদা প্রায় আড়াই লাখ টন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের গত দশ মাসে (জুলাই’১৬ইং থেকে এপ্রিল’১৭ইং পর্যন্ত) ১৪ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন চিনি আমদানি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। এরমধ্যে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৬ লাখ ১৮ হাজার টন আমদানিকৃত অপরিশোধিত চিনি (র-সুগার) খালাস হয়। সম্প্রতি এস আলম, মেঘনা গ্রæপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪ জাহাজে ১ লাখ ৬০ হাজার টন র-সুগার আমদানি হয়েছে। আগের ও বর্তমান আমদানি মিলিয়ে মজুদ বা স্থিতি থাকার কথা ৪ লাখ টন। আমদানিকৃত বেশিরভাগ চিনির শুল্কায়িত মূল্য পড়ে কেজিপ্রতি গড়ে ৫০ টাকা পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দর স্থিতিশীল থাকলেও দেশের বাজার হয়ে উঠেছে দেশীয় বেপরোয়া সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বেসামাল।     
দেশে সিংহভাগ চিনি আমদানি, রিফাইন্ড মিলে পরিশোধন করে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, ইগলু গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ ও দেশবন্ধু। আর চিনির প্রধান এজেন্ট হলো খাতুনগঞ্জের মীর গ্রুপ। গতবছর ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানকালে মুনাফাখোরির কারণে হাতেনাতে অভিযুক্ত হয় খাতুনগঞ্জের মীর গ্রুপ এবং প্রতিকেজি চিনিতে ১২ টাকা হারে অতিরিক্ত মুনাফাখোরির দায়ে মীর গ্রুপকে অর্থদন্ড করা হয়। আটক করা হয় এই ব্যবসায়ীক গ্রুপটির মালিকসহ তিন জনকে। পরবর্তীতে মুচলেকা দিয়ে সেই মজুদ চিনি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হয়। আমদানিকারক, মিল মালিক ও এজেন্টের কাছ থেকে বড় বড় পাইকাররা চিনি কিনে নিয়ে এখন যথেচ্ছ মূল্যে বাজারজাত করছে। এ অবস্থায় অস্থির হয়ে পড়েছে চিনির বাজার।
মজুদদারদের চিনি ও ছোলার  গুদামগুলো সিলগালা করুন -মহিউদ্দিন চৌধুরী     
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চিনি ও ছোলা মজুদদার সিন্ডিকেটের গুদামগুলো অবিলম্বে সিলগালা করে দেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন। গতকাল (রোববার) এক বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, চট্টগ্রাম মহানগরীর বাইরে সিটি গেইট থেকে কুমিরা হয়ে সীতাকুন্ড পর্যন্ত পাটকলের গুদাম ভাড়া নিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোলা ও  চিনি মজুদ করা হয়েছে। এসব জনস্বাস্থের জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি অভিযোগ করেন, সমুদ্রপথে ১২শ’ ভোগ্যপণ্যবাহী কার্গো ভেসেল ভাসমান রয়েছে। যা সিন্ডিকেট কর্তৃক মূল্যবৃদ্ধির অপকৌশল।
পবিত্র রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ছোলা ও চিনির দাম নির্ধারণে চট্টগ্রাম জেলা প্রাশাসনের একক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে টিসিবি।  
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, এখন বাজারে যে ছোলা রয়েছে তার আমদানি প্রক্রিয়া শুরু হয় ৩ মাস পূর্বে। এই ছোলা বর্তমানে মণপ্রতি ২ হাজার ৬শ’ ৫০ টাকা ও কেজিপ্রতি ৭৫ টাকায় বিক্রি কেজিতে ৪ টাকা লাভ হয়। একইভাবে মিল রেইট অনুযায়ী এক কেজি চিনির দাম সর্বোচ্চ হতে পারে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। গতবছর বাজারে কেজিপ্রতি ছোলার দাম ছিল ৭৫ টাকা এবং এই দরে ১৫ দিন আগেও ছোলা বিক্রি হয়েছে।  
মহিউদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে বর্ধিত হারে ছোলার দাম কেজি প্রতি ৮০ টাকা ও চিনির দাম ৬৩ টাকা নির্ধারণ করে দেয়ায় বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা জেলা প্রশাসনের বেঁধে দেয়া দামের নিচে ভোগ্যপণ্য বিক্রি না করার সুযোগ পেয়েছে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার যখন মাহে রমজানে ভোগ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বদ্ধপরিকর তখন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তার বর্ধিত হারে দাম নির্ধারণ সরকারি নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। তার এই অযাচিত ভূমিকা সরকারের ভাবমর্যাদাকেই ক্ষুণœ করেছে।



 

Show all comments
  • জাফর ৮ মে, ২০১৭, ১১:৩৭ এএম says : 2
    দ্রুত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চিনি

২৬ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ অক্টোবর, ২০২২
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ