হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
তৈমূর আলম খন্দকার
সভ্যতার ক্রমবিকাশের কারণেই বিচার ব্যবস্থার বিবর্তন। সভ্যতা যখন বিকশিত হতে থাকে তখন থেকে যেভাবেই কথাটা আসুক না কেন, এটাই দ্রæব সত্য যে, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এ আলোকেই বিচারক নিয়োগ, বিচার পদ্ধতি নির্ণয় ও বিচার নিষ্পত্তি হয়ে আসছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিংশ শতাব্দিতে এসেও আমাদের শুনতে হয় যে, ‘বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে’ এবং ‘বিচার বেচা কেনা হয়।’ আরো কথা চাউর হয় যে, ‘হাওয়া দেখে বিচারের রায় হয়’ অর্থাৎ ‘যার হাতে ক্ষমতা, রায় তার পক্ষেই যায়’। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যতিসম্পন্ন দেশবরণ্য আইনজ্ঞ ও বিশিষ্টজনদের এটাই মন্তব্য।
বিচারকের সমালোচনা করা যাবে না। কারণ তাদের কর্মকাÐের কেউ যাতে সমালোচনা না করতে পারে এ জন্যই আদালত অবমাননার আইন করা রয়েছে। আদালতের সম্মান সমুন্নত থাকুক, আইনের শাসন বাস্তবায়নের স্বার্থেই আমরা এটা চাই। আদালতের ভাবমর্যাদা যত বৃদ্ধি পাবে আইনজীবীদের সম্মান ততই বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু এখন আদালত অবমাননার আইন ব্যবহৃত হচ্ছে বিচারকের অপকর্ম ঢাকা দেয়ার অস্ত্র হিসেবে। এখানে আলোচ্য বিষয়টি আদালত অবমাননার উদ্দেশ্যে না হলেও বিচার সংক্রান্ত কথা উঠলে আদালতের প্রসঙ্গ এসে যায়।
বহু বিবর্তনের পর বর্তমানে আমাদের দেশের আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থার যে কাঠামো তার যদি একটু সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতির অধীনে আইন, শাসন ও বিচার ব্যবস্থা নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাগজে-কলমে স্বাধীন। তদুপরি ১/১১ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ডিন্যান্স করে বিচার বিভাগকে স্বাধীন করেছেন। তারপরেও দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠে বিচার বিভাগ কি প্রকৃত পক্ষেই স্বাধীন? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির মুখে মুখে তো বিচার বিভাগ অবশ্যই স্বাধীন। কিন্তু এর বাস্তব চিত্র কী? আইন করে স্বাধীন করার পরও যদি তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন তবে এর জন্য দায়ী কে? তবে ২৫ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহা এক সভায় স্বীকার করেন যে, বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। তাছাড়া গত ১৫ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সম্বর্ধনা সভায় প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহা বলেছিলেন, ‘প্রশাসন কখনো চায়নি বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করুক, বরাবরই তারা বিমাতা সুলভ আচরণ করছে। প্রশাসনে যারা উচ্চ পর্যায়ে আছে, তাদের পরিচালনা করে কয়েকজন আমলা।’ প্রতি উত্তরে ২৬ এপ্রিল আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন যে, ‘কোন দেশের প্রধান বিচারপতিরা প্রকাশ্যে এতো কথা বলেন না।’
বিচার বিভাগের সাথে প্রসঙ্গক্রমেই আইন বিভাগের কথা উঠে আসে। জাতীয় সংসদ আইন প্রণেতা। আইন প্রণীত হবে জনগণের কল্যাণে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইন প্রণেতা বা ক্ষমতাসীনদের রক্ষার জন্যই আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ কারণেই কমিউনিস্ট এক বিপ্লবী নেতা পার্লামেন্টকে শুয়োরের খোঁয়াড়ের সাথে তুলনা করেছেন। সে ভাষায় কথা না বললেও এটাই বলা বাহুল্য যে, পার্লামেন্ট ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে জনতার উপর স্টিম রোলার চালানোর নিমিত্তে কঠিন কঠিন আইন পাশের একটি ফ্যক্টরিতে পরিণত হয়েছে। এ আইন ফ্যক্টরি সংবিধানের মৌলিক চাহিদা পূরণে কতটুকু সফল তা অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। এ ফ্যাক্টরি থেকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত¡বধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ধারার বিলুপ্ত হয়েছে। যারা ফলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে এক অনিশ্চয়তার অন্ধকার।
দেশের আপামর জনগণ রক্ত দিয়ে দেশটি স্বাধীন করে ছিল সার্বভৌম কল্যাণমূলক একটি রাষ্ট্রের জন্য, যা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ আছে যে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার কি নিশ্চিত হয়েছে? নিম্মোক্ত পর্যালোচনায় এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি।
সরকারি দলের ওয়ার্ড লেভেলের নেতা থেকে শুরু করে মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত যে কেউ যে কোন বিষয়ে বক্তৃতা বা কথা বলুক না কেন খালেদা জিয়া সন্ত্রাসের রাণী, খালেদা জিয়া বোমা বাজ, খালেদা জিয়া ঘরে থাকলে দেশ নিরাপদ, খালেদা জিয়া মানুষ পোড়াচ্ছে প্রভৃতি বাক্য উচ্চারণ করে গলা ফাটাচ্ছেন। শুধু তাই নয় পেট্রোল বোমায় আহত-নিহতদের পক্ষে মামলা হয়েছে, সে মামলাও বিএনপি চেয়ারপার্সনকে আসামী করা হয়েছে। তাকে (খালেদা জিয়া) গ্রেফতারের দাবিতে মন্ত্রীদের নেতৃত্বে মিছিল, মিটিং, মানববন্ধন, সমাবেশ ও টকশোতে দাবি করা হয়েছে। সকল কিছু উপেক্ষা করে খালেদা জিয়া ছিলেন অবিচল ও অটল। তিনি নিজেও সাংবাদিক সম্মেলন ও বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য ও বিবৃতির মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার নিন্ধা করেছেন। একটি গণতান্ত্রিক দলের একজন কর্মী হিসাবে আমি মনে করি যে- উদ্দেশ্যমূলকভাবে মানুষ পুড়িয়ে মারা একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হতে পারে না। আমি নিজেও বোমা বিস্ফোরণে মানুষ হত্যার বিরোধী। সরকার নিজেও জানে যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবৈধ এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকার প্রমাণ করেছে যে, খালেদা জিয়ার দাবিই সত্য; কেন না এ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়েছে ভোট ডাকাতির নির্বাচন, যাতে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে সরকার নির্বাচন কমিশন ও আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে।
সকল বিষয়ে খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া, বিএনপি ও ২০ দলকে দোষারোপ করা হচ্ছে একমাত্র ৫ জানুয়ারির একতরফা অবৈধ নির্বাচনের কলঙ্ককে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যার জন্য খালেদা জিয়া দায়ী, মন্ত্রীরা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের জোর দাবি জানিয়েছেন। বক্শীবাজারে স্থাপিত একটি আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারী করেন। প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা এবং গুলশান কার্যালয়ে ফিরে আসার নিশ্চয়তা পেলে তিনি আদালতে হাজির হবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন। এর পরও ৩৮ দিনে গ্রেফতারি পরোয়ানা বক্শীবাজার থেকে গুলশান পৌঁছেনি। সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বলেছেন- ‘তোমার আমার বেলায় হলে বুঝতে গ্রেফতারি পরোয়ানা কত তাড়াতাড়ি পৌঁছে?’ আমার প্রশ্ন, গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু এবং ৩৮ দিনেও বক্শীবাজার থেকে গুলশানে না পৌঁছার পিছনে জনমনে কী ধারণা হয়েছে? এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ মনে করে যে- সরকারের ইচ্ছায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হয় আবার সরকারের ইচ্ছায়ই তার গতি স্থবির হয়ে যায়; যেখানে আদালতে নিজস্ব কোনো এখতিয়ার নেই। এমনিভাবে আদালত’কে সরকার নিজস্ব হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যেমনটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ জাতীয় প্রতিটি স্বাধীন সংস্থাকে। কাগজে-কলমে স্বাধীন তারা যতই হোক সুবিধামত পোস্টিং এবং সিনিয়রিটি ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন তো সরকারের হাতে। আমাদের দেশের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দেশপ্রেম আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ তারা স্বাধীনভাবে নিজ দ্বায়িত্ব পালনের চেয়ে সরকারকে তুষ্ঠ রেখে লোভনীয় পোস্টিং এবং সিনিয়রিটি ডিঙ্গিয়ে প্রমোশন নেয়ার জন্য বেশি আগ্রহী। তাই জনগণের ভাগ্যে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ন্যায় বিচার আজ জনগণের চিন্তার বাহিরে। ন্যায্য অধিকার ভোগ করার প্রশ্নই উঠে না; সরকারি দল ছাড়া সকলেই যেন স্বাধীন দেশের নয় বরং দেশের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। ভুক্তভোগী জনগণ ছাড়া কেউ হয়তো এ কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করবেন না। যারা সরকারের সুবিধা পাচ্ছে তারা এমনভাবে সরকারের ডামাঢোল পিটাচ্ছে যাতে মনে হয় সরকার একটি ধোয়া তুলশী পাতা।
সম্পদের সুষম বণ্টন এবং যে গণতন্ত্রের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি হলো, সেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সংবিধানে ১১৭ক অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বাকশাল কায়েম করে সর্বস্তরে গণতন্ত্রের মুখে তালা দেয়া হলো। গণতন্ত্র রক্ষা ও মৌলিক অধিকারের নামে শাসক গোষ্ঠীর শাসন করার অধিকারের আইন প্রণয়ন করা হয়েছে; কিন্তু জনগণের অধিকার রক্ষায় বা শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের রক্ষার আইন প্রণয়ন হয় না। যদিও জনকল্যাণের নামে আইন হয় কিন্তু এর প্রয়োগ হয় জনগণকে শোষণের জন্য। দেশে আইনের প্রয়োগ চলছে এখন দুইভাবে। সরকারি দলের জন্য যেভাবে আইন প্রয়োগ হয় বিরোধী দলের জন্য হয় তা উল্টোভাবে। যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন পাশ হয়েছে- দুর্নীতি দমনের জন্য। কিন্তু এর প্রয়োগ হচ্ছে একপেশে। ১/১১ সামরিক জান্তা বেষ্টিত সরকার অনেক রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে দুদক আইনে মামলা দিয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর হাই কোর্টের বিচারপতিদের রায়ে বা দুদকের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি এবং প্রধানমন্ত্রীর সব-মামলা খালাস এবং বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া ও তার দলীয় লোকদের মামলা এখনো ঝুলে আছে। উল্লেখ্য, বিচারপতি শামছুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) (সাবেক অ্যাপিলেট ডিভিশনের বিচারপতি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলার শুনানীর সময় প্রকাশ্যে বলেছিলেন- ‘দুদকের অফিসারদের পিটানো উচিৎ’। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার মামলায় কি তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন? এতেই প্রমাণিত হয় যে, হাওয়া বুঝে বিচারের রায় হয়।
সামরিক জান্তা এসে বারবার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে বা গণতান্ত্রিক যাত্রার ব্যাঘাত ঘটিয়েছেÑ এ অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এর পিছনে কি বিচার বিভাগের কোন সহযোগিতা নাই? সামরিক জান্তাকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়ে বঙ্গভবনে বসান কে? আজ পর্যন্ত কোনো প্রধান বিচারপতি কি কোন সামরিক জান্তাকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃত জানিয়েছেন? বলতে পারেন, প্রাণের ভয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মহামান্য প্রধান বিচারপতি শপথ পাঠ করিয়েছেন। যদি তাই হয় তবে এটাই সত্য যে, প্রাণের ভয়ে সামরিক জান্তাকে বহাল করার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি বরং সহযোগিতা করেছে। এখানে ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচারপতির জীবনের মূল্য বেশি, তাই গণতন্ত্র রক্ষার পরিবর্তে ধ্বংসে নিজেকে জড়িত করেছেন। গণতন্ত্র রক্ষায় ফুটপাতের নুর হোসেন যে ভ‚মিকা রেখেছে সেই ভ‚মিকা রাখাও কোনো বিচারপতির পক্ষে সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য গুলিবিদ্ধ নুর হোসেনের গায়ে লিখা ছিলÑ ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। নুর হোসেন যে গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছে- আজকের গণতন্ত্রের চেহারা দেখলে সে লজ্জা পেতো।
প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিÑ সকলেই আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা করার কথা বলেন। আইনের শাসনে প্রতিষ্ঠার প্রধান শর্তÑ স্বাধীন বিচার বিভাগ। প্রশ্ন হলো, বিচার বিভাগ কি স্বাধীন? যদি না হয় তবে এ জন্য দায়ী কে? সংবিধানের ২য় পরিচ্ছেদের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে - ‘এ সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে বিচার কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিষ্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।’ সংবিধান এতো বড় নিশ্চয়তা দেয়ার পরও বিচারক, ম্যাজিষ্ট্রেটগণ নিজেদের কি স্বাধীন ভাবেন? বিষয়টি দৃশ্যমান যে, পুলিশ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাতেই ম্যাজিষ্ট্রেটগণ সিদ্ধান্ত দেয়। যেমন- পুলিশ রিমান্ড বিচার প্রার্থীর জন্য একটি আতঙ্ক। রিমান্ডের আদেশ দেয়ার পূর্বে রিমান্ড সম্পর্কিত যুক্তিকথা অনেক সতর্কতার সাথে বিবেচনার জন্য শুধু বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে নয় পাক-ভারত উপমহাদেশ এবং ব্রিট্রিশ উচ্চ আদালতের দিক নির্দেশনা রয়েছে। অথচ বিরোধীদলীয়- জাতীয় পর্যায়ের নেতাদের এখন মামলায় রিমান্ড দেয়া হচ্ছে যেখানে রিমান্ডের কোন যৌক্তিকতা নাই। পূর্বে প্রদত্ত রিমান্ড থেকে এখন পর্যন্ত মামলা তদন্তের অগ্রগতি দেখাতে পারছে না। বিরোধী দলীয় রাজনীতি নস্যাৎ করার জন্য আদালতকে সরকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার কারছে এবং সুবিধামত পোস্টিং ও প্রমোশনের বদৌলতে আদালত সরকারের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেÑ এটাই বর্তমানে সর্বস্তরের অভিযোগ; যা জনমনে হতাশার সৃষ্টি করছে। ফলে দেশ এখন পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক মামলায় ক্ষমতাসীনরা যাদের নাম দেয় পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে এজাহার করে। এজাহারে নাম থাকলে সেখানে আর জামিন নাই। পুলিশী ফরোয়ারডিংয়ের বাইরে আদালতের সিদ্ধান্ত হয় না। বিচারের পূর্বেই বিচার হয়ে যাচ্ছে। এটাই সাধারণ মানুষের পারসেপসন।
পরিশেষে বলতে চাই যে বিভিন্ন কারণে মানুষ মনে করে যে, বিচার বিভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এ ধারণা থেকে জনগণকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচারকগণ মন-মগজে নিজেকে যদি স্বাধীন মনে না করেন তবে আইন করে বা বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন বানানো যাবে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষায় সকলের স্বার্থে সকলেরই সক্রিয় হওয়া উচিৎ। গত ৩০ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট যদি দেখে দেশে আইনি শাসন হচ্ছে না। শুধু দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যই (এমপি) নয়, পুরো সংসদ মিলে যদি সংবিধানকে পরিবর্তন করে দেয়, জনগণের অধিকার ক্ষুণœ করে কোন আইন সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিল করতে সুপ্রিম কোর্ট পিছপা হবে না।’
প্রধান বিচারপতি এ বক্তব্যে বুঝা যায় যে, তিনি জনগণের অধিকার রক্ষায় বদ্ধ পরিকর। তার বক্তব্যে এটাও প্রতিয়মান হয় যে, দেশে আইনের শাসন নেই। তবে বিরোধী দল ও বিশিষ্ট আইনজ্ঞাদের মতে দেশের আইন দু’ ধারায় প্রয়োগ হয়ে আসছে। যারা ক্ষমতায় রয়েছে তাদের জন্য আইনের প্রয়োগ হয় এক পদ্ধতিতে এবং ক্ষমতাহীনদের প্রশ্নে প্রয়োগ হয় কঠিনের চেয়ে কঠিনতরভাবে। প্রধান বিচারপতি বিষয়টির প্রতি কতটুকু যতœবান রয়েছেন তা সময়ই বলে দিবে।
বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র ঔপনিবেশিক ভাবধারায় গঠিত। দেশ দু’বার স্বাধীন হলেও এ ঔপনিবেশিক হীনমন্যতা থেকে আমলারা বেরিয়ে আসতে পারেননি। আমলারা ন্যায় অন্যায় বুঝেন না, তারা বুঝেন যার কাছে ক্ষমতা তাকেই তুষ্ঠ রাখা। গণতন্ত্রের জন্য এ মানুষ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছে। সেই গণতন্ত্রই এখন ভূলুণ্ঠিত। একটি নিরপেক্ষ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচনই গণমানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে পারে। বিগত ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতাসীনরা হরিলুটের নির্বাচন করে। তাই প্রধান বিচারপতির দৃষ্টিতে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থাটি বাতিলের মাধ্যমে জনগণের অধিকার ক্ষুণœ হয়েছে কি না সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।