Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বেপরোয়া অর্থ পাচার

| প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম


বেশ কয়েক বছর ধরে মাঝে মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে অবৈধপথে টাকা পাচার নিয়ে তোলপাড় করা সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বরাবরই দেশের অর্থনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের উদ্বেগ লক্ষ্য করা গেছে। মানি লন্ডারিং বন্ধে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কথাও শোনা গেছে। তবে সে সব উদ্যোগ যে কোন কাজে আসছেনা  টাকা পাচারের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক রিপোর্ট থেকেই তা’ বুঝা যাচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গেøাবাল ফিনানন্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই) তাদের ২০১৪ সালের প্রতিবেদনে সে বছর বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে। যদিও  জিএফআই রিপোর্ট অনুসারে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ২৫৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মূদ্রায় তা’ ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল আগের বছরের চেয়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশী। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৭হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছিল। বিশ্বের প্রায় সবদেশের মূদ্রা পাচারের অবস্থা সম্পর্কেই জিএফআই বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। ‘উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধ অর্থপ্রবাহ শীর্ষক’ জিএফআই প্রতিবেদন অনুসারে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৫৮৫কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে পরবর্তি এক দশকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার বেড়েছে।
গত ১০ বছরে অবৈধভাবে পাচার হওয়া অর্থের পরিমান দুইটি জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বিদেশে পাচার হওয়া টাকার পারিমান চলতি অর্থবছরের সংশোধিত উন্নয়ন বাজেটের কাছাকাছি। দেশে যখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের খরা চলছে, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক রেমিটেন্স এবং রফতানী খাতের প্রবৃদ্ধিতে যখন ভাটার টান, তখন এক অর্থবছরেই প্রায় লক্ষকোটি টাকা অবৈধ পথে বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য অনেক বড় অশুভ সংকেত। এ ধরনের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্থ পাচার রোধে কার্যকর পন্থা নির্ধারণ ও তার প্রয়োগেও ব্যর্থ হচ্ছে সরকার। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা বা দুর্নীতি দমন কমিশন কিছুই করতে পারছেনা। অর্থ পাচার প্রতিরোধে আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা এমন দাবী করলেও টাকা পাচারের ক্রমবর্ধমান হার থেকেই বোঝা যায় এই দাবীর কোন প্রামান্য ভিত্তি নেই। টাকা পাচার রোধে তাদের কথিত সব প্রয়াসই কার্যত ব্যর্থ। লক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে, ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ অংকের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, যে বছর দেশে একটি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তা চরমে পৌছেছিল। প্রধান বিরোধিদল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিকদলকে অংশগ্রহনের বাইরে রেখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ব্যবসায়ীরা এ টাকা পাচার করেছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।
জালিয়াতির মধ্য দিয়ে আমদানী-রফতানী খাতের মাধ্যমে অধিকাংশ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে জানা যায়। বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ পদ্ধতিতে অর্থ পাচারের সাথে জড়িতদের খুঁেজ বের করা অসম্ভব নয়। তবে সরকারের সংশ্লিষ্টরা বেশ হম্বিতম্বি করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। বিশেষত: দুনীতি দমন কমিশন ছোটখাট দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে মাঝে মধ্যেই বেশ তোলপাড় সৃষ্টি করলেও বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা নিয়ে যেন তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিক, শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বিদেশে সেকেন্ড হোমের নামে, আমদানী-রফতানীর নামে ভুয়া এলসি এবং মিথ্যা ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে ফোঁকলা করে দিলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কিছুই করতে পারলনা। শেয়ারবাজারের লুটপাট, ব্যাংক জালিয়াতির সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়ার পর কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের কারো কোন শাস্তি হয়নি। টাকাও উদ্ধার হয়নি। বিপিসি’র আমদানী করা জ্বালানী তেলের মূল্য বেশী দেখিয়ে সচিব উপসচিবসহ সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৪ সালে দুদকের পক্ষ থেকে মামলার চার্জশিট দেয়ার সুপারিশ করা হলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় দুর্নীতির ধারাবাহিকতা অব্যহত রয়েছে। অবৈধ পন্থায় লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের সাথে জড়িতদের ধরতে এবং পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে এফবিআইসহ আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তা নিতে হবে। তবে সব ধরনের দুর্নীতি ও অর্থপাচার বন্ধে দুদককেই মূল ভ’মিকা পালন করতে হবে। দুদক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকান্ডের সমন্বয় থাকতে হবে। ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক যে সব ব্যবস্থা নিচ্ছে তার পাশাপাশি প্রতিমাসে হাজার হাজার কোটি টাকার পাচার ও লুটপাট হয়ে যাওয়ার রন্ধ্রগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন