Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভ্যাট নিয়ে হুমকি পাল্টা হুমকি

| প্রকাশের সময় : ৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বাজেটপূর্ব যৌথ পরামর্শক সভায় এক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে। সভায় ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু মোতালেব বলেন, মূসক আইন নিয়ে এ পর্যন্ত এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের মধ্যে ১৮টি সভা হয়েছে। সভার ফলাফল শূন্য। দাবি মানা না হলে ছাত্রদের মতো ব্যবসায়ীরা আবার রাজপথে নামবে। এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী আন্দোলন দমনের পাল্টা হুমকি দেন। এতে ব্যবসায়ীদের অনেকেই হুমকির প্রতিবাদ করে বলেন, এনবিআর সরকারকে ভুল বোঝাচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, মূসক আইন নিয়ে ব্যবসায়ী ও সরকারের মধ্যে দুই বছর ধরেই মতবিরোধ চলছে। নতুন এই আইনে আমদানি কিংবা উৎপাদন, সরবরাহ ও বিক্রি পর্যায়ে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এতে উৎপাদন খরচ যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি জিনিসপত্রের দামও বৃদ্ধি পাবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পাবে। ব্যবসায়ীরা চান এই হার কমিয়ে ৭ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা হোক। অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, ১৫ শতাংশ হার বেশি। আশপাশের কোনো দেশে এই হার নেই। এটা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। ব্যবসায়ীদের সাথে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে ১০ শতাংশ করা উচিত।
বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিনিয়োগে চরম খরা বিরাজ করছে। প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন টিকে থাকার সংগ্রাম করছে, তেমনি অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেও চালু করা যাচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইনকে নিবর্তনমূলক মনে করছে। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি পণ্যমূল্যও বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে যে টানাপড়েন চলছে, তাতে আরও টান ধরবে। এ কথা সবার জানা, পুরো হাওর অঞ্চলে যে ফসল হয় এবং দেশের খাদ্যে ১৭ শতাংশ যোগান দেয়, তা এবারের অকাল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পুরোপুরি তলিয়ে গেছে। প্রতিদিনই দেশের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে ফসল বিনষ্ট হচ্ছে। কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। বিশাল এক শস্য ভান্ডার যখন ধ্বংস হয়ে যায়, তখন তার প্রভাব পুরো দেশে পড়া স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে সব ধরনের চালের দাম কেজি প্রতি গড়ে ৪ থেকে ৫ টাকা বেড়ে গেছে। হাওর অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ নিঃস্ব হয়ে খাদ্য সংকটে পড়েছে। সরকারি যে সহযোগিতা তা তাদের জন্য যথেষ্ট নয়। অনেকে বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। এক নিদারুণ সংকটের মধ্যে তারা পড়েছে। এর প্রভাব যে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এ পরিস্থিতিতে যদি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ আইন কার্যকর হয়, তবে তা অনেকটাই মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেবে। আমরা লক্ষ্য করেছি, সরকার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান খাতটিকে কোনোভাবেই চাঙ্গা করতে পারছে না। দেশের অর্থনীতির জন্য তা সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে রয়েছে। সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উন্নয়ন কর্মকান্ডের অর্থ যোগান দিতে তাকে দফায় দফায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বৃদ্ধি নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব সাধারণ মানুষ কোনো রকমে শহরে দিন গুজরান করেন, এই মূল্যবৃদ্ধি তাদের উপর এক অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর সাথে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি তাদের আরও কাবু করে ফেলছে। অথচ সরকারের কাজই হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাপনকে সহজ করে তোলা। সরকার নিজে কষ্টে থেকে জনসাধারণের আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। দুঃখের বিষয়, আমরা দেখছি সরকার এ কাজ না করে, তার আয় কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়-এ নীতি অবলম্বন করে চলেছে। সরকারের এ মনোভাবের কারণে ইতোমধ্যে অর্থনীতিবিদরা তাকে ‘ব্যবসায়ী সরকার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অথচ সরকারের কাজ ব্যবসা নয়, জনসেবা। সরকার তার রাজস্ব আয় নিশ্চয়ই বাড়াবে। এতে কারোই আপত্তি নেই। তবে তা কখন, কীভাবে, কতটা সহনীয়ভাবে ধীরে ধীরে করা যায়, এ চিন্তাও তো মাথায় রাখা উচিত। একবারে বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে? ব্যবসায়ীরা বলেছেন, দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী সাধারণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে দেশের দুই কোটি ৭০ লাখ ব্যবসায়ীর মধ্যে দুই কোটি ২০ লাখ ক্ষদ্র ব্যবসায়ী মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবেন। এই ব্যবসায়ীরা যখন ক্ষতির শিকার হবেন, তখন এর প্রতিক্রিয়াও সাধারণ মানুষের উপর পড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ভ্যাট বাড়লে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতিও মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এটা কি দেশের অর্থনীতিতে কোনো সুফল বয়ে আনবে?
আমরা মনে করি, ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিত। ব্যবসায়ীরা যে ভ্যাট দিতে চাচ্ছে না, বিষয়টি এমন নয়। তারা ভ্যাট দিতে চাচ্ছে ৭ থেকে ১০ শতাংশ হারে। সরকারের নির্ধারিত হার তাদের জন্য কষ্টকর হবে বিধায় তারা এর বিরোধিতা করছে। যদি সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তবে তা যেমন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সুখকর হবে না, তেমনি সাধারণ মানুষও কষ্টের মধ্যে পড়ে যাবে। আইনটির এই ধারাবাহিক কুফল সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। এছাড়া আইনটি প্রয়োগ করতে গিয়েও জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এতে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধার সার্বিক দিক বিবেচনা করে সরকারকে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের রাজস্ব আয়ও যাতে যথাযথভাবে হয়, ব্যবসায়ীরাও যাতে সন্তুষ্ট থাকে-এ বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। চাপ প্রয়োগ বা চাপে ফেলে কোনো কিছু আদায় করা সরকারের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। আমরা আশা করব, হুমকি-ধমকির মাধ্যমে নয়, পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সার্বিক সুবিধা-অসুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করে ভ্যাট নির্ধারণ করা উচিত।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন