Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিসিএস-উত্তীর্ণরা নিয়োগবঞ্চিত হবে কেন?

| প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত হচ্ছে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস)-এ অংশগ্রহণ করা। সাধারণত মেধাবী চাকরি প্রার্থীরা এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধা যাচাইয়ের মাধ্যমে সুযোগ পেয়ে থাকেন। প্রিলিমিনারি টেস্ট, লিখিত ও মৌখিক- এই তিন ধাপে নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারলে নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী সরকারের উচ্চ স্তরে চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। এই ধাপ অতিক্রম করার পর প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি অপরাধের অভিয়োগ আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে প্রতিবেদন দেন গোয়েন্দারা। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে বিগত কয়েকটি বিসিএস-এর ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটতে দেখা গেছে। দেখা গেছে, প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডের অভিযোগ না থাকলেও শুধুমাত্র পরিবারের কোনো সদস্যর ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে নেতিবাচক মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে। ‘জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে’, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ মন্তব্য উল্লেখ থাকায় সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে চাকরি পাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে ঠুনকো অভিযোগ বা তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনের কেউ যদি সরকার বা স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত থাকেন, সে ক্ষেত্রে ওই প্রার্থীকে নিয়োগবঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার একই প্রার্থীর ক্ষেত্রে দুই গোয়েন্দা সংস্থার দুই ধরনের প্রতিবেদন দেয়ার কারণেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। অনেক শ্রম ও মেধা খাটিয়ে যেসব প্রার্থী চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে শুধু গোয়েন্দা প্রতিবেদন বা ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের কারণে তাদের নিয়োগ স্থগিত করা হবে, এটা কোনোভাবেই উচিত নয়। এ ধরনের প্রবণতা মেধার ভিত্তিতে দক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।
জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড এমনকি কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট লোকজনের দক্ষতা এবং যোগ্যতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর মূল কারণই হচ্ছে, মেধার পরিবর্তে সরকারি দলের লোকজনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া। প্রায় প্রত্যেক সরকারের আমলেই এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ হরহামেশাই উঠছে। এই সময়ে এসে এ ধরনের অভিযোগ গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এমনও শোনা গেছে, প্রার্থীর মেধার প্রয়োজন নেই, দলের লোক হলেই তাকে নিয়োগ দিতে হবে। বিসিএসের মতো মেধা যাচাইয়ের সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে এ ধরনের নিয়োগ যখন হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশাসনের দক্ষতা ও যোগ্যতা হ্রাস পাবে। এ সময়ে এসে আমরা যখন বলছি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবো, আগামী দুই দশকের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবো, তখন প্রশাসনে মেধার দিক বিবেচনা না করে ক্ষমতাসীন দলের কম মেধাসম্পন্ন বা ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হলেই নিয়োগ দিতে হবে- এমন মানসিকতা কি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে? শুধু তাই নয়, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এবং এর মান নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন উঠছে। চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাসের হার দেখলে বিস্মিত হতে হয়। শতভাগ পাসের রেকর্ড হচ্ছে। হাজার হাজার জিপিএ ৫ পাচ্ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে জিপিএ ৫ ধারীদের সিংহভাগই ফেল করছে। এ থেকে শিক্ষার মান কোথায় গিয়ে নামছে, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকার মেধা দিয়ে পড়াশোনা করে বিসিএসের মতো উন্নত মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে উত্তীর্ণ হচ্ছে, গোয়েন্দা প্রতিবেদনের নামে তাদের অনেককেই দুঃখজনকভাবে চাকরি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। প্রার্থীর কোন দোষ-ত্রæটি না থাকলেও তার আত্মীয়-পরিজন কোন রাজনীতির সাথে জড়িত তার সাথে ওই প্রার্থীর সম্পর্ক বিবেচনা করে চাকরি বঞ্চিত করা কোনো সুস্থ মানসিকতা হতে পারে না। প্রার্থীর আত্মীয়-স্বজনের কারণে প্রার্থীকে কেন বঞ্চিত করা হবে? এ ধরনের মানসিকতাকে দেশকে মেধা বঞ্চিত করার অনভিপ্রেত কাজ ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে! বলা বাহুল্য, মেধাবীর মেধা কাজে না লাগিয়ে হতাশার দিকে ঠেলে দেয়ার অর্থ দেশকে মেধাশূন্যর দিকে ধাবিত করা। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের নামে যে আচরণ করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। এতে সরকারের ভাবমর্যাদাও যেমন ক্ষুণœ হচ্ছে, তেমনি দক্ষ ও সক্ষম প্রশাসন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদন সব সময় সঠিক হবে, এমন দাবি করা যায় না। অনেক সময় তা বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে। গোয়েন্দারা প্রার্থীর এলাকায় গিয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার সময় সত্যিকার তথ্য উঠে আসা নিয়েও অনেক সময় বিভ্রাট সৃষ্টি হয়। প্রার্থী স্থানীয় অনেকের শত্রæতারও শিকার হয়। কেবল মাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে কারো চাকরি না হওয়ার অর্থ কি এই, সরকারি দল ও মতের না হলে কেউ বিসিএসে উত্তীর্ণ হতে পারবে না? এটা কি কোনো মেধাভিত্তিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে? অথচ রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সংশ্লিষ্ট যোগ্যতা অনুযায়ী বিসিএস বা সরকারি চাকরি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আমরা মনে করি, দক্ষ প্রশাসন গড়ে তুলে দেশকে উন্নতি ও অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে। কারণ এ রাষ্ট্র সবার। এখানে বিভিন্ন মত ও পথ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ থাকা স্বাভাবিক। তাই ভিন্ন মতাবলম্বী হলে কেউ চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হবে বা চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে নিয়োগ পাবে না, তা হতে পারে না। মেধাবীদের দূরে ঠেলে দিয়ে দেশের উন্নতি ও অগ্রযাত্রা আশাও করা যায় না। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই থাক না কেন, যেসব প্রার্থী যোগ্য এবং অপরাধমুক্ত তাদের অবিলম্বে নিয়োগ দেয়া দেবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন