বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
জালাল উদ্দিন ওমর : গত ১৬ এপ্রিল তুরস্কে গণভোট অনুষ্ঠিত হলো। এতে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রস্তাবিত হ্যাঁ ভোট সামান্য ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছে। এরদোগানের পক্ষে ভোট পড়েছে ৫১.৩৭ শতাংশ এবং বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৪৮.৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ ২.৭৪ শতাংশ ভোট বেশি পেয়ে এরদোগানের প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধন অনুমোদিত হয়েছে। তবে এরদোগান সার্বিকভাবে সামান্য ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলেও দেশটির প্রধান তিনটি শহর ইস্তাম্বুল, আংকারা ও ইজমিরে তিনি পরাজিত হয়েছেন। এই গণভোটের মাধ্যমে তুরস্কে সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু হতে যাচ্ছে। এটা ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর হবে। এই সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। একজন প্রেসিডেন্ট পর পর দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবে না। তবে পার্লামেন্ট মনে করলে দ্বিতীয় মেয়াদ সংক্ষিপ্ত করে আগাম নির্বাচন দিতে পারবে এবং সে ক্ষেত্রে আগের প্রেসিডেন্ট আরো এক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত হবে এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ সৃষ্টি হবে। নির্বাহী ক্ষমতার মালিক হবেন প্রেসিডেন্ট। মন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং বরখাস্ত করার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়বে। প্রেসিডেন্ট প্রয়োজন মতে ডিক্রি জারি করতে পারবেন এবং জরুরি অবস্থাও জারি করতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট হবেন সরকারের নির্বাহী প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধান। এই সংবিধানের মাধ্যমে গোটা দেশের কর্তৃত্ব এরদোগানের হাতে চলে যাবে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলয় ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বিচার বিভাগ, সামরিক বিভাগ, পার্লামেন্ট সবই তার হতে থাকবে। এই হচ্ছে নতুন সংবিধান অনুসারে প্রেসিডেন্টের প্রাপ্ত ক্ষমতার সার সংক্ষেপ। এদিকে প্রস্তাবিত সংবিধান গণভোটে পাস হবার পরদিনই এরদোগান তার দেশে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আবারো বৃদ্ধি করেছেন। তুরস্কে সাংবিধানিক এই পরিবর্তন আমার দৃষ্টিতে একটি অপ্রয়োজনীয় কাজ, যার মাধ্যমে আপাতত কেবল এরদোগানই লাভবান হবেন। সংশোধিত সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা অর্পণ করায় তুরস্কে আগামীদিনে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, ফলে এরদোগানের দল বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কারণ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্য না থাকলে সে ক্ষেত্রে একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যাই বলুক না কেন, আমি মনে করি তুরস্কে গণভোটের মাধ্যমে যে সংবিধান প্রণীত হয়েছে, তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এর মাধ্যমে সুকৌশলে এরদোগান নিজের ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করেছে এবং ক্ষমতাকে নিরঙ্কুুশ করেছে। কারণ বর্তমানে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সুতরাং সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তার সুফল অটোমেটিক্যালি তিনি ভোগ করবেন এবং তিনি তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন। এদিকে নতুন সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট পর পর দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবে না। তবে পার্লামেন্ট মনে করলে দ্বিতীয় মেয়াদ সংক্ষিপ্ত করে যেহেতু আগাম নির্বাচন দিতে পারবে এবং সে ক্ষেত্রে আগের প্রেসিডেন্ট আরো এক মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন, সেহেতু এর পুরো সুফল কিন্তু এরদোগানই ভোগ করবেন। এদিকে নতুন সংবিধান ২০১৯ সাল থেকে কার্যকর হবে। এই সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন হবে। তার মানে নতুন সংবিধান কার্যকর হবার আগেই এরদোগান তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছর শেষ করবেন। এরপর আরো দু’বার অর্থাৎ দু’মেয়াদে পাঁচ বছর করে দশ বছর এবং দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হবার আগে আগাম নির্বাচন করলে আরো এক মেয়াদ অর্থাৎ আরো পাঁচ বছর প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। যদি দ্বিতীয় মেয়াদ শেষের এক বছর আগে নির্বাচন হয় তাহলে ২০১৯ সালের পর প্রথম মেয়াদে পাঁচ বছর, দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছর (এক বছর আগে আগাম নির্বাচন হবার কারণে) এবং তৃতীয় মেয়াদে আরো পাঁচ বছরসহ মোট আরো চৌদ্দ বছর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন। অর্থাৎ ২০৩৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ এখন বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের হাতে এসে গেছে। যদি রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ঠিক থাকে, এরদোগান জীবিত থাকেন এবং নির্বাচনে বিজয়ী হন, তাহলে সংশোধিত সংবিধান অনুসারে বর্তমানে ৬৩ বছর বয়সী এরদোগান আজ থেকে আরো কমপক্ষে ১৫ বছর প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন।
এরদোগান বার বার বলছেন নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় তিনি কখনো স্বৈরাচার হবেন না এবং তুরস্কের উন্নয়নের স্বার্থেই নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। আমরাও বিশ^াস করলাম যে এরদোগান অত্যন্ত ভালো মানুষ এবং তিনি স্বৈরাচার হবেন না। কিন্তু এরদোগান তো আর চিরদিন বাঁচবেন না। সুতরাং এরদোগান পরবর্তী প্রেসিডেন্ট যদি সংবিধানের প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বৈরশাসন চালু করেন এবং দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দেন, তখন তাকে রুখবে কে? এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন জাগে, সেটা হচ্ছে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টের হাতে এত ক্ষমতা অর্পণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার আগে করেননি কেন? অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্যজন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় এই আইন পাস করেননি কেন? আর আগামী নির্বাচনে এরদোগান যদি পরাজিত হন অথবা অন্য কোনোভাবে তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত হন, তাহলে এই সংবিধান এরদোগান, তার দল এবং তুরস্কের কাউকেই রক্ষা করবে না। তখন এরদোগানের তৈরি সংবিধানই তার গলার কাঁটা হবে। একইভাবে এরদোগান পরবর্তী সময়ে এই সংবিধানই এরদোগানের দল এবং তুরস্কের সর্বনাশ করবে। বিভিন্ন ভুল এবং বিতর্কতি সিদ্ধান্তের কারণে এরদোগানের জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। যার কারণে বিগত সংসদ নির্বাচনে প্রথম দফা ভোটে তার দল সরকার গঠনের মতো একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, ফলে সেখানে দ্বিতীয় দফা সংসদ নির্বাচন করতে হয়েছিল। আর এবারের গণভোটে এরদোগান পক্ষ খুব অল্প ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি মাত্র ২.৭৪ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন। সংখ্যায় যার পরিমাণ মাত্র ১৩ লাখ। আর ১৩ লাখের ভোটারের মন পরিবর্তন একটি সহজ বিষয়। সুতরাং আগামীতে এরদোগান ও তার দলের বিপদ আছে। এদিকে এরদোগানের দলে এরদোগানের বিকল্প কোনো নেতা কিন্তু নেই। ফলে এরদোগানের অবর্তমানে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং ক্ষমতাসীন করা অত্যন্ত কষ্ঠসাধ্য হবে। সুতরাং এরদোগান যে ভুল পথে হাঁটছেন সেই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আসলে আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা আমাদের সমর্থক বা প্রিয় মানুষদের কোন ভুল দেখি না এবং সমালোচনাও করি না। ফলে ভুল সংশোধন হয় না এবং ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়।
২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় থেকেই এরদোগান রাজনীতিতে ভুল পথে হাঁটছেন। তার পররাষ্ট্রনীতি বরাবরই ভুল। তিনি বার বার ইউটার্ন দিচ্ছেন। সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে অতি বন্ধুত্ব এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক হানির পর এরদোগান এখন আবার রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক কমাতে চাইছেন। আসলে এটা হচ্ছে এমন একটা বাস্তবতা, যাকে এড়িয়ে চলার কোনো সুযোগ এরদোগানের নেই। এর মাধ্যমে এরদোগান তার অতীত ভুল থেকে সরে আসতে চাইছেন, যা ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরদোগানের বিকল্প কোনো পথ নেই। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ^ যে এরদোগানের প্রকৃত বন্ধু নয়, তা তিনি অবশেষে বুঝতে পেরেছেন। একইভাবে সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদকে সরানো যে সম্ভব নয়, তাও এরদোগান আজ বুঝতে পেরেছেন। তাই এরদোগান আজ সিরিয়ার ক্ষমতায় আসাদকে মেনে নিয়ে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক পুনস্থাপনের চেষ্টা করছেন। এক সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাবিরোধী শক্তি রাশিয়া, চীন, ইরান এবং সিরিয়ার সাথে এরদোগানের ভালো সর্ম্পক ছিল। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে গিয়ে এরদোগান হয়ে যান আসাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। এই ইস্যুতে রাশিয়া, চীন এবং ইরানের সাথে এরদোগানের সম্পর্ক শীতল হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কের উষ্ণতা তৈরি হয়। কিন্তু দীর্ঘ যুদ্ধ সত্তে¡ও সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদের পতন না হওয়ায় এবং ২০১৬ সালের ১৫ জুলাইয়ের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা এরদোগানের পাশে না আসায়, এরদোগান বুঝতে পেরেছেন যে তিনি ভুল পথেই হেঁটেছেন। তাই এখন এরদোগান যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে তার পুরনো বন্ধু রাশিয়া, চীন এবং ইরানের বলয়ে ভীড়তে চাইছেন। এমনকি এরদোগান এখন সিরিয়ার ক্ষমতায় আসাদকেও মেনে নিচ্ছেন। আসলে সবকিছু ধ্বংস করার পর এখন এরদোগান তার ঐতিহাসিক ভুল বুঝতে পেরেছেন এবং বাস্তবতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। এটা হচ্ছে এরদোগানের বিলম্বিত বোধোদয়। মনে রাখতে হবে আবেগ আর বাস্ততা এক জিনিস নয়। তাই প্রতিটি ঘটনাকে গভীর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে এবং বাস্তবতার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মুসলিম বিশে^ তুরস্ক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী একটি দেশ। এশিয়া এবং ইউরোপের সংযোগ স্থাপনকারী ও ন্যাটোর সদস্য দেশ হিসেবে পশ্চিমা বিশে^ তুরস্কের আলাদা পরিচয় ও প্রভাব রয়েছে। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার দল জাস্টিস এন্ড ডেভেলাপমেন্ট পার্টি অতি আলোচিত একটি নাম। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামপন্থী এই দলের উত্থান এবং ক্ষমতায় আরোহণ ছিল বিশ^জুড়ে একটি আলোচিত বিষয়। অনেক চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে এবং প্রতিক‚লতাকে জয় করে দলটি তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দলটির নেতৃত্বে তুরস্কে ইসলামী সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং মূল্যবোধের বিকাশ হয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে দলটির যাবতীয় কর্মকান্ড এবং উত্থান। এরদোগানের নেতৃত্বে দলটি ২০০২ সাল থেকে একটানা তুরস্কের ক্ষমতায় এবং দলটির নেতা এরদোগান ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। ২০১৪ সালে এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হন এবং বর্তমানে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট। এরদোগান হয়ে ওঠেন তার দল এবং দেশের অবিসংবাদিত নেতা। এ অবস্থায় ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যা জনগণ ব্যর্থ করে দেয়। ফলে এরদোগান এখনো তুরস্কের ক্ষমতায়। এ অভ্যুত্থানের জন্য এরদোগান যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা গুলেনকে দায়ী করেন এবং গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে চরম দমন অভিযান চালান। অথচ এই গুলেন এক সময় এরদোগানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন এবং গুলেনের সমর্থনেই এরদোগান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। ২০১২ সাল পর্যন্তই এই গুলেন ছিলেন এরদোগানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা গুলেন কেন আরেক ধর্মীয় প্রবক্তা এরদোগানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করতে যাবেন, তা বোধগম্য নয়। গুলেন এবং হিজমত আন্দোলনের বিরুদ্ধে এরদোগান এত ক্ষুব্ধ কেন তারও যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যাখ্যা নেই। আসলে এটা হচ্ছে গুলেনের প্রতি এরদোগানের ব্যক্তিগত আক্রোশ। এরদোগান এবং গুলেন দু’জনই জাতীয়তাবাদী, দুজনই ইসলামের অনুসারী, দুজনই ইসলামের পুর্নজাগরণ চান এবং দুজনই ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশ চান। অথচ গুলেন ও তার দলকেই এরদোগান প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলেছেন।
এরদোগান মুসলিম বিশে^র একজন আশাবাদী নেতা হলেও, তার ভুল নীতি মুসলিম বিশ^কে ধ্বংস করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, আমরা কেউ তার সমালোচনা করিনি এবং তার ভুলগুলো ধরিয়ে দিইনি। আমরা কখনই আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর ভুল ধরি না। আমরা মনে করি তাদের সব কাজই সঠিক। কিন্তু বাস্তবে তা ঠিক নয়। যখন সব হারাই তখন ভুলটা বুঝতে পারি। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। এরদোগানের বেলায়ও এটা সত্য। ২০১১ সালে মুসলিম দেশে দেশে যে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয় তাকে ব্যবহার করে পশ্চিমারা তাদের বিরোধী শাসকদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমা বিরোধী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করছে। এসব বিদ্রোহীদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিকভাবে সাহায্য করছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব। সাথে রয়েছে তুরস্ক, সৌদি আরব এবং কাতারসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ। পিছন থেকে ইসরাইল কলকাঠি নাড়ছে। অপরদিকে আসাদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ইরান, রাশিয়া, চীন ও লেবানের হিজবুল্লাহ। এই যুদ্ধে ইতোমধ্যেই প্রায় চার লাখ মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। প্রতিদিনই প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য নিরাপরাধ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিদিনই অসহায় মানুষেরা বাঁচার তাগিদে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ধ্বংসযজ্ঞ চলছে তো চলছেই। আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সকল তৎপরতার হেড কোয়ার্টার তুরস্কে অবস্থিত। বিদ্রোহীদের অফিস, সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং রাজনৈতিক তৎপরতা সবই তুরস্কে মাটিতে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রত্যক্ষ তত্ত¡াবধানে তুরস্কের মাটি থেকে আসাদবিরোধী কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তুরস্কের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ সীমান্তের সুযোগে বিরোধীরা অবাধেই তুরস্ক হয়ে অস্ত্র পাচ্ছে। এরদোগানের এই নীতি হচ্ছে ইতিহাসের সেরা ভুল। এরদোগান শুধু শুধু একটি সংকট সৃষ্টি করেছেন, যার কারণে মুসলমানদের কেবল ক্ষতিই হয়েছে। একইভাবে পশ্চিমারা তাদের দীর্ঘদিনের আরেকশত্রæ লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সেøাগান দিয়ে তারা লিবিয়ায় হামলার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস করে। এরপর পশ্চিমা বিশ্ব লিবিয়ায় সামরিক হামলা শুরু করে। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী তার বাহিনী নিয়ে পশ্চিমাদের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করেন। তিনি তিন সন্তানসহ জীবন দেন। এভাবে পশ্চিমারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লিবিয়ার শাসক গাদ্দাফীকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। আর দেশটিকে ধ্বংস করে। গাদ্দাফী পরবর্তী লিবিয়া আজ এক ধ্বংসের জনপদ। লিবিয়ার জনগণ আজ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার কিছুই পায়নি। লিবিয়া আজ বহু খন্ডে বিভক্ত একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এখানেও পশ্চিমাদের সহযোগী হিসাবে কাজ করেন তুরস্কের এরদোগান। লিবিয়াকে ধ্বংস করার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল মিশরের ক্ষমতা থেকে নির্বাচিত ইসলামপন্থী প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পশ্চিমারা পাশ্চাত্য বিরোধী ড. মুরসিকে কৌশলে আরেক পাশ্চাত্য বিরোধী আসাদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেন। এক্ষেত্রেও পশ্চিমাদের পক্ষে অবতীর্ণ হন এরদোগান। তিনি আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আসাদবিরোধী পদক্ষেপ নিতে মুরসিকে উদ্বুদ্ধ করেন যা মূলত ছিল পশ্চিমাদেরই পরিকল্পনা। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল বিরোধী মিশরের প্রেসিডেন্ট ড. মুরসি, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের আরেক প্রধান শত্রু আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দেন। এটা ছিল মুরসির ঐতিহাসিক ভুল। পশ্চিমা বিশ্ব এটাই চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলের দুই শত্রু ড. মুরসি এবং আসাদ যখন নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে গেছে তখনই পশ্চিমারা ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি সম্পন্ন করে। পশ্চিমারা মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজ তাড়াতাড়িই শুরু করে এবং আসাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের দুই মাসের মধ্যেই ড. মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। গণতন্ত্র হত্যাকারী মিশরের সেনাবাহিনীকে নীরবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। মিশরের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত কয়েক হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও এক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রবক্তা যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নেয়। এরদোগান এখানেও পশ্চিমাদের পক্ষেই ছিলেন। অবশ্য এরদোগান পরবর্তীতে তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।