Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

১৫ শতাংশ ভ্যাট অগ্রহণযোগ্য

| প্রকাশের সময় : ২৫ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

১ জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু করতে যাচ্ছে সরকার। ভ্যাট থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে এই আইনে প্যাকেজ ভ্যাট বাতিল করে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর ব্যবস্থা করছে। নতুন এই ভ্যাট আইন কার্যকর হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সব ধরনের সেবার খাতের দাম বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে জীবনযাত্রার যেমন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাবে। সার্বিক অর্থনীতির ওপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে তার প্রতিক্রিয়ায় দেশীয় শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতাও কমে যাবে। এতে অর্থনীতির গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব আশঙ্কা আমলে না নিয়েই সরকার নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বলেছে, আইনটি ব্যবসায়ী ও ভোক্তাবান্ধব নয়। এর কারণ হচ্ছে, ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনাও ভেস্তে যেতে পারে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০০৯ সাল থেকে আইনটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি সংসদে পাস হয়েছে ২০১২ সালে। আইনটি যদি ভালো হতো, তবে এত দিনে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন হতো। ইতোমধ্যে এফবিসিসিআই আইনের কয়েকটি বিতর্কিত ও ধ্বংসাত্মক ধারা সংশোধন করতে সরকারের সঙ্গে ২০১২ সাল থেকে সভা করে আসছে। অর্থমন্ত্রীর গঠিত এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের যৌথ কমিটি বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের জন্য একমত হলেও, হঠাৎ করেই সরকার সেখান থেকে সরে এসেছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নতুন ভ্যাট আইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী থেকে শুরু করে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, চিকিৎসা ব্যয়, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সাধারণ ভোক্তা শ্রেণীর ওপর যেমন অতিরিক্ত আর্থিক চাপ পড়বে, তেমনি তাদের ক্রয় সক্ষমতা হ্রাস ও চাহিদা কমবে। অর্থনীতির নিয়মে ভোক্তা চাহিদা কমলে উৎপাদনও হ্রাস পাবে। এতে সার্বিক অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়বে। অন্যদিকে দেশীয় পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের পাশাপাশি ৪৪৭টি আমদানি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। অর্থাৎ বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম কমে যাবে। এর ফলে দেশে উৎপাদিত পণ্য বিদেশি পণ্যের কাছে বাজার হারিয়ে এক হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। দেশ বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সরকার যেন দেশকে বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত করতে চাচ্ছে। বলা বাহুল্য, দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ ও প্রসারণের পরিবর্তে সঙ্কুচিত করার পদক্ষেপ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু নয়। পরনির্ভরশীলতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি আশা করা যায় না, তা একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। সবচেয়ে বেশি বোঝে সরকার। তারপরও সরকার জেনেবুঝে কেন এমন আত্মবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তা বোধগম্য নয়। অথচ সরকারের সাধারণ কর্তব্য হচ্ছে, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করা। ভোক্তাদের জীবনযাত্রা চাপমুক্ত ও সাবলীল রাখা। আমরা দেখছি উল্টোটা। সরকার তার আয় বাড়ানোর জন্য যে কোনো উপায়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করার নানা ফন্দিফিকির করে চলেছে। ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করলে ব্যবসায়ীসহ সাধারণ মানুষের কী দুর্গতি হবে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করছে না। এমনিতেই প্রতিনিয়ত নিত্যপণ্যসহ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি সামাল দিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, এর সাথে সরকার আবার ভ্যাটের মতো সর্বগ্রাসী আইন প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? শুধু সাধারণ মানুষই নয়, উৎপাদক এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারিসহ সব শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা এই ভ্যাট আইনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হবেন। ব্যবসায়ীরাই বলছেন, দেশের ৮৫ শতাংশ ব্যবসায়ী সাধারণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শ্রেণীর। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে দেশের দুই কোটি ৭০ লাখ ব্যবসায়ীর মধ্যে দুই কোটি ২০ লাখ ক্ষদ্র ব্যবসায়ী মারাত্মক ক্ষতির শিকার হবেন। এই ব্যবসায়ীরা যখন ক্ষতির শিকার হবেন, তখন এর প্রতিক্রিয়াও সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভ্যাট বাড়লে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতিও মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এটা কি দেশের অর্থনীতিতে কোনো সুফল বয়ে আনবে? দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত পোশাক শিল্প। এ শিল্প দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে বহুদিন ধরেই ধুঁকছে। ইতোমধ্যে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের মতো প্রতিষ্ঠানের নানামুখী চাপের কারণে প্রায় দুই হাজারের মতো গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও উদ্যোক্তারা নিজেদের কর্মদক্ষতা দিয়ে এ খাতটিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। নতুন ভ্যাট আইন প্রয়োগ হলে দেখা যাবে এ খাতটি আরো নাজুক হয়ে পড়বে। কারণ নতুন ভ্যাট আইনে রফতানি পণ্যের সঙ্গে ব্যবহৃত স্থানীয় বা আমদানি করা অন্য সব পণ্যের ওপর ভ্যাট আরোপিত হবে। এর ফলে খাতটির উৎপাদন ও চাহিদা কমে যাবে। অথচ বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী ভিয়েতনামে শুধু রফতানি পণ্যই নয়, পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করতে আনুষঙ্গিক আরো যেসব পণ্য ও সেবা প্রয়োজন, তার সবই ভ্যাট-ট্যাক্সমুক্ত। এই ভ্যাট আরোপের সবচেয়ে অমানবিক দিক হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী ওষুধের ওপর প্রয়োগ করা। দেশের অনেক দরিদ্র মানুষ যেখানে অর্থের অভাবে ওষুধ কিনতে পারে না, সেখানে তাদের কাছে এই ভ্যাট চাওয়া শুধু দুঃখজনকই নয়, অমানবিকও বটে।
সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য যদি কোনো আইন করতে হয়, তবে তা সহনীয় মাত্রায় করা উচিত। এমন কোনো করের বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়, যার ভার তারা বইতে অক্ষম। সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আইন যে জনগণের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে এবং কষ্টের মধ্যে ফেলে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে বলেছেন, বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে এ ভ্যাট আইন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। দেশের শিল্প ও সেবা খাত এত ভ্যাটের ভার বহনের সক্ষমতা এখনো অর্জন করেনি। এ ভ্যাট কোনোভাবেই ৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়। আমরা আশা করব, সরকার ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভ্যাট আইনটিকে সহনীয় করে তুলবে। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও সাধারণ মানুষের সমস্যার কথা চিন্তা করে অবশ্যই আইনটি সংশোধন করা প্রয়োজন। সরকারকে ব্যবসা করার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। জনসাধারণের জীবনযাপনকে চাপে না ফেলে সহজ করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হবে। এখানে গোয়ার্তুমি করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়।



 

Show all comments
  • Md Mahbubur Rahman ২৫ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:৫৯ এএম says : 0
    আমরা জানি সিংগাপুর হচেছ সবচেয়ে উচছ কর আদায়কারী দেশ তবু ৭% কিনতু আমাদের দেশের মানুষের যে আয়ের হার তাতে চোর ডাকাত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না, যদি ১৫% কর হয়
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন