হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর
গত ১৪ এপ্রিল সারা দেশে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে গেল মহাসমারোহে। পহেলা বৈশাখ প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ হিসেবে পালিত হয় বলে পহেলা বৈশাখ পালন উপলক্ষে এদিন আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে এক ধরনের বাঙালিত্ববোধ নতুনভাবে জেগে ওঠে। আমাদের দেশের মানুষের এ বাঙালিত্ব বোধ বছরের আরেকটি দিনেও জেগে ওঠে। সেটি একুশে ফেব্রæয়ারি। উনিশশো বায়ান্ন সালের ওই তারিখে তদানীন্তন পাকিস্তানে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এদেশের তরুণেরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে এমন এক ইতিহাসে সৃষ্টি করে যে, এর পর বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির বিরুদ্ধে আর কেউ অবস্থান গ্রহণের সাহস পায়নি। ইতিহাস গবেষকদের স্মরণ থাকার কথা, পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এ সংগ্রামে আমাদের বিজয়ের ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার এ সংগ্রামে বিজয়ের পথ ধরেই পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও স্বাধিকার চেতনা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে এদেশে গণ-মানুষের এ স্বাধিকার চেতনাকে পাকিস্তান বাহিনী পশুবলে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হলে বাংলার দামাল ছেলেরা জীবনবাজি রেখে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নয় মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ নামের স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এ সংগ্রামের শেষ পর্যায় সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করলেও এ সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের তদানীন্তন সভাপতি কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের ওই কাউন্সিল অধিবেশনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত ওই প্রস্তাবে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিলÑ উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহে একাধিক স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ব্যতীত অন্য কোনো প্রস্তাব ভারতবর্ষের মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
যদিও ওই প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দ ছিল না, পর দিন সকল হিন্দু পত্রিকায় এই সংবাদটি প্রকাশিত হয় ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’ বলে। মুসলিম লীগও তার পরবর্তী মাদ্রাজ অধিবেশনে ওই প্রস্তাবভিত্তিক আন্দোলনকে পাকিস্তান আন্দোলন হিসেবেই মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়নের আন্দোলনে এগিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তদানীন্তন বৃটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের মুসলমানরা ওই দাবির পক্ষে ব্যাপক সমর্থন জ্ঞাপন করে। তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলা প্রদেশে ওই দাবিতে মুসলিম লীগ জয়লাভ করায় জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার গঠন করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের টিকিটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় দিল্লিতে, তাতে ওই সম্মেলনের মূল প্রস্তাব উত্থাপনের দায়িত্ব পড়ে বাংলার প্রতিনিধি দলের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর।
জনাব সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক উত্থাপিত যে প্রস্তাব সম্মেলনে গৃহীত হয় তাতে লাহোর প্রস্তাবের আংশিক সংশোধন করে উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহে একাধিকের পরিবর্তে আপাতত একটি (পাকিস্তান) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তবে এই প্রস্তাব উত্থাপনকালীন তাঁর ভাষণে এক পর্যায়ে জনাব সোহরাওয়ার্দী বলেন, অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই আপনার শেষ দাবি কিনা। আমি এ প্রশ্নের কোনো জবাব দেব না। তবে এ কথা আমি অবশ্যই বলব, এ মুহূর্তে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই আমার প্রধান দাবি। অর্থাৎ তিনি ভবিষ্যতে উপমহাদেশের মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলে লাহোর প্রস্তাবের মর্যানুসারে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র (বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেন না।
এবার আমরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের এ লেখা শুরু করেছিলাম সেই বাংলা সনের প্রথম তারিখে যে বাংলা নববর্ষ পালন করা হয় সেই বাংলা সনের ইতিহাস প্রসঙ্গে ফিরে যাব। বাংলা সনের জন্ম হয় মোগল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে। তখন এদেশে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে প্রচলিত ছিল হিজরি সাল। হিজরি সাল চান্দ্রসন বিধায় এ ছিল সদা পরিবর্তনশীল। এতে প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। সে কারণে হিজরি সনকে সৌর সনে পরিবর্তিত করে বছরের ফসলকেন্দ্রিক উপযুক্ত নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে দিয়ে ফসলি সন হিসেবে বাংলা সনের জন্ম দেয়া হয়। সেই নিরিখে দেখা যায়, বাংলা সনের জন্ম মোঘল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে ইসলামী ঐতিহ্যবাহী হিজরি সনকে সৌরবর্ষে রূপান্তরের মাধ্যমে।
এভাবে আমরা আমাদের বাঙালিদের বিভিন্ন গৌবরজনক উৎস সম্বন্ধে সন্ধান করতে গেলে দেখতে পাব বাঙালিত্বের এ গৌরবজনক উৎসগুলো হচ্ছেÑ বাংলা সন, বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলা সনের জন্ম যেহেতু মোগল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে, আকবরের দরবারের সন বিশেষজ্ঞ আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজী কর্তৃক হিজরি সনের সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে, সুতরাং এই বাংলা সনের মূল উৎস হিজরি সনÑ এ বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
এর পর আসে বাংলা ভাষার প্রসঙ্গ। সাধারণত বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নির্ধারণের লক্ষ্যে পরিচালিত ভাষা আন্দোলনের কথা এলেই উনিশশো বায়ান্নর একুশে ফেব্রæয়ারির ঐতিহাসিক ঘটনাবলির কথা স্মরণ করি। কেউ কেউ বড় জোর, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে বাংলাকে তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ববঙ্গব্যাপী সে প্রথম সফল হরতাল পালিত হয় এবং যার ফলে সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকায় অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার কথা স্মরণ করি। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পরিচালিত সেই আন্দোলনের ফলে ঢাকায় ১১ মার্চ যে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তার জের চলতে থাকে ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ পর্যন্ত। এই অরাজক পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রাদেশিক চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ১৫ মার্চ তারিখেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবি-দাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর এ ভীতির কারণ পরবর্তী ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা আসার কথা ছিল। ঢাকায় এসে জিন্নাহ সাহেব যদি এ অরাজক পরিস্থিতি দেখেন তাতে খাজা নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভালো থাকার কথা নয়।
অবশ্য ভাষা আন্দোলনের সূচনা ১৯৫২ সালে তো নয়ই, ১৯৪৮ সালেও নয়। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস কর্তৃক “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে। তবে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হলেও ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই। সংশ্লিষ্ট সকলের জানা থাকার কথা স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দি হবে, সে বিষয়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পূর্বাহেৃই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে মুসলিম লীগ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তর্ক-বিতর্ক চলাকালেই পাকিস্তান কায়েম হয়ে যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বলে মত প্রকাশ করলে বিখ্যাত ভাষা বিশেষজ্ঞ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অকাট্য তথ্য-যুক্তি দিয়ে তার বিরোধিতা করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে অভিমত দান করেন।
বৃটিশ শাসনামলেই ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে তার রাষ্ট্রভাষা কী হবে এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। ১৯১৮ সালের দিকে মহাত্মা গান্ধী রবীন্দ্রনাথের কাছে জানতে চান ভারতবর্ষ স্বরাজ লাভ করলে সাধারণ ভাষা কী হবে। রবীন্দ্রনাথ তার জবাবে লেখেন, অনলি হিন্দি ক্যান বি দ্যাট ল্যাঙ্গুয়েজ। অর্থাৎ একমাত্র হিন্দিই হতে পারে সে ভাষা। শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত এ সম্পর্কিত এক আলোচনা সভায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অবশ্য বলেছিলেন, বাংলা-উর্দু-হিন্দি এই তিন ভাষারই যোগ্যতা রয়েছে রাষ্ট্রভাষা হওয়ার। বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এই তিন ভাষা তিন রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষা হওয়াতে এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের দূরদর্শিতাই প্রমাণিত হয়। বৃটিশ শাসনামলে পার্টিশনের প্রশ্ন ওঠার অনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী একবার বলেছিলেন, অন্য প্রদেশে যাই হোক, বঙ্গদেশে বাংলাই হতে হবে সরকারি ভাষা।
বাঙালি জাতির গৌরবের ধন তিনটিÑ বাংলা সন, বাংলা ভাষা এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি বাংলা সনের জন্ম হয় ইসলামের ঐতিহ্যবাহী হিজরি সনের সৌর সনে রূপান্তরের মাধ্যমে মোগল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে। সে নিরিখে বাংলা সনের জন্মের পেছনে মুসলমানদের গৌরবজনক অবদান রয়েছে। বাকি থাকে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা। বাংলা ভাষার জন্ম পাল রাজত্বকালে হলেও শৈশবেই বাংলা ভাষার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয় দাক্ষিণাত্য থেকে আসা সেন বংশ বাংলার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়ার ফলে। সেন আমলে সংস্কৃতকে বাংলার রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হয় এবং বাংলা ভাষা চর্চাকে এই যুক্তিতে নিরুৎসাহিত করা হয় যে, সংস্কৃত হচ্ছে দেবতাদের ভাষা আর বাংলা হচ্ছে মনুষ্যসৃষ্ট ভাষা। শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মণদের দিয়ে এমন ফতোয়াও জারি করা হয় যে, দেবতার ভাষা সংস্কৃতকে অবহেলা করে যারা মনুষ্য সৃষ্ট বাংলা ভাষা চর্চা করবে, তারা রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে।
এহেন পরিস্থিতিতে বাংলা ভাষা চর্চাকারীদের অস্বিত্ব চরম হুমকির মুখে পতিত হয়। তবে অলৌকিকভাবে এ সময় বাংলায় ইখতেয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজীর সামরিক অভিযানের ফলে সেন রাজত্বের পতন হয় এবং মুসলিম শাসনের সূত্রপাত হয়। বঙ্গে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলা ভাষার শৈশবকালীন সংকটের অবসান হয়। মুসলিম শাসনামলে হিন্দু-মুসলিম ধর্ম নির্বিশেষে সকল ঐতিহ্যের সাহিত্য সাধনার অবারিত সুযোগ লাভ করেন বাংলা সাহিত্য সাধকেরা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাস প্রমাণ করে সে সময় বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই বাংলা সাহিত্যের উত্তরোত্তর উন্নত ও সমৃদ্ধি দ্রæতগতিতে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এরপর উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের পতন যুগে উর্দু ভাষার উৎপত্তি হলে কিছু সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে পুনরায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মুসলমানদের প্রাচীনপন্থি ও আধুনিক উভয় উচ্চতম শিক্ষা কেন্দ্র দেওবন্দ ও আলীগড় উর্দু অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় প্রাচীনপন্থি ও আধুনিক-পন্থি শিক্ষিতদের অনেকেই উর্দুতে কথাবার্তা বলতে গৌরব বোধ করতেন। তবে পরবর্তীকালে ১৯১১ সালে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠা হলে এবং আরও পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনকালে কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রেরণায় মুসলমানরা বাংলা সাহিত্য সাধনায় এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা লাভ করে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংস্থার কার্যক্রমের ফলে বাংলা ভাষার রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে কলকাতার পরিবর্তে ঢাকা।
সর্বশেষে বাঙালির নেতৃত্বাধীন স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা। বৃটিশ শাসনের অবসানে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে সকল বাঙালির সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর যৌথ উদ্যোগে। সে উদ্যোগের প্রতি মুসলিম লীগ নেতা কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন থাকলেও কংগ্রেসের গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল প্রমুখ অবাঙালি নেতা এবং শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি প্রমুখ বাঙালি হিন্দু মহাসভা নেতার প্রবল বিরোধিতার কারণে সে চেষ্টা ভÐুল হয়ে যায়। সে সময় শেষোক্ত নেতা (শ্যামা প্রসাদ) এমনও বলেছিলেন, ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ হতেই হবে। নইলে বাঙালি-হিন্দু চিরকালের জন্য বাঙালিী মুসলমানের গোলাম হয়ে যাবে। অথচ এদেরই পূর্বসূরিরা ১৯০৫ সালে প্রধানত প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত বিশাল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে ভাগ করে ঢাকা রাজধানীসহ ‘পূর্ববাংলা ও আসাম’ নামে নতুন প্রদেশ গঠন করা হলে তা বঙ্গমাতার অঙ্গছেদের মতো পাপ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদের এসব স্ববিরোধী কর্মকাÐকে উপেক্ষা করে বাঙালি মুসলমানরা লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে বাঙালিদের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।