Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঋণের নিম্নগতিতে তারল্যের পাহাড়

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের : বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ‘বানরের তৈলাক্ত বাঁশে’ আটকা পড়েছে সেই ২০১৩ সালে। সূচকটি উপরে উঠতে তো পারছেই না, বরং হর হর করে নিচে নেমে যাচ্ছে প্রতিবছর। সূচকটিকে উপরে টেনে তুলতে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে না পারলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভিন্ন উপায়ে চেষ্টা চালিয়েছে একাধিকবার। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এতে বিনিয়োগযোগ্য অলস টাকার (তারল্য) স্ত‚প জমেছে ব্যাংকগুলোতে। ভল্টে এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকার অলস অর্থ থাকায় আমানত নেয়াই বন্ধ করে দিয়েছে ‘স্বাভাবিক অভ্যাসে’ অনেকগুলো ব্যাংক  ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যদিও চট্টগ্রামের একটি বিতর্কিত গ্রæপের কব্জায় থাকা ব্যাংকগুলো করছে অস্বাভাবিক আচরণ। ওই গ্রæপটিকে সব টাকা বের করে দেয়ায় আমানতকারীদের টাকাই ফেরত দিতে পারছে না বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আর্থিক খাতে বর্তমানে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে থাকলেও ৯ থেকে ১০ শতাংশ সুদে এখনো আমানত সংগ্রহ করছে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো, যা আবার চলে যাচ্ছে ওই গ্রæপটির হাতে।
‘বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে না পারায় ব্যাংকগুলোর কাছে উদ্বৃত্ত তারল্য জমা হচ্ছে’- এমন মত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের।
এসব অর্থের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত সুদ গুনতে হচ্ছে উল্লেখ করে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘বিনিয়োগের অনুক‚ল পরিবেশ না থাকায় উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন না। এর ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে সরকারি বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করছে।’
‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত মনে হলেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা এখনো  কাটেনি’- এমন মত ব্যক্ত করেছেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, ‘এ কারণে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন না।’
বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে বিনিয়োগ না বাড়ার কথা বলেছেন বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাচ্ছে না। গ্যাসের সঙ্কট এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। বেশি দাম দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ।’
ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘেœ বিনিয়োগ করতে পারে সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে এগিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন ড. সালেহউদ্দিন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১২ সাল পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। এক পর্যায়ে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে রাশ টানতে একাধিক সার্কুলারও জারি করতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। তবে ২০১৩ সাল থেকেই বদলে যায় চিত্র। ওই বছর ঋণের প্রবৃদ্ধিতে যে ধস নামল, আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। বেসরকারি ঋণের হিসাবে বিদেশি উৎস থেকে সংগৃহীত ঋণ যোগ এবং ভোক্তা ঋণ সহজ করেও ঋণ প্রবৃদ্ধিতে গতি আনতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধস, এর পরপরই আবাসন খাতে বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক মন্দার সরাসরি প্রভাব পড়ে দেশের শিল্প-বাণিজ্যে। এরপর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তায় টালমাটাল হয়ে ওঠে অর্থনীতি। এর উপর একের পর এক প্রকাশ পেতে থাকে দেশের ইতিহাসের বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারি। এর প্রেক্ষিতে ঋণ প্রদানে কঠোরতা আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ প্রদানে শিথিল হয়, কেটে যায় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা- তখন বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে সামনে আসে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কোনো উপায়েই ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে না পেরে ৪ এপ্রিল সার্কুলার জারি করে ভোক্তা ঋণের লিমিট প্রায় দ্বিগুণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১২ সালের জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বেড়েছিল ২৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পরের বছরের জানুয়ারিতে এই হার হঠাৎ কমে ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে যায়। ২০১৪ সালে ঋণের প্রবাহে গতি আরো কমে। জানুয়ারিতে এতে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ১১ দশমিক ১৭ শতাংশ। এর প্রেক্ষিতে অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি উৎস থেকে বেসরকারি খাতে নেয়া ঋণ মোট বেসরকারি ঋণের সঙ্গে যোগ করে হিসাব করা শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সার্কুলার জারি করে শিথিল করে ভোক্তা ঋণ। এতেও কাজ হয় না। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে হয় মাত্র ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ। গতবছরের জানুয়ারিতে এই হার আরো কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩০ শতাংশে। তবে আশার দিক হলো, এ বছরের জানুয়ারিতে এই ঋণ প্রবাহে কিছুটা গতি এসেছে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ। যদিও তা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে ২০১৭ সালের জুন নাগাদ অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। তবে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত গড় প্রবৃদ্ধি মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ বছরের জানুয়ারিতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা বাড়ার মূল কারণ বিদেশি উৎস থেকে ঋণ প্রবাহ বাড়া। দেশের বেসরকারি খাতে এ পর্যন্ত ৮০ হাজার কোটি টাকা ঋণ এসেছে বিদেশি উৎস থেকে। তাই সার্বিক ঋণের প্রবাহ বাড়লেও দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ বাড়েনি এক টাকাও।
এতে ‘দেশের ব্যাংকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে’ উল্লেখ করে প্রাইম ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ কামাল খান চৌধুরী বলেন, ‘তবে এর মাধ্যমে উদ্যোক্তারা কম সুদে ঋণ পাচ্ছেন যা দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো।’
চলতি অর্থবছরের শুরুতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া গেছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) হিসাবেও। সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে বিনিয়োগ আগের তিন মাসের তুলনায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেড়েছে ৫৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এ সময় স্থানীয় বিনিয়োগ ২৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ১৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এ বছরের প্রথম তিন মাসে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ৩৩ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত বছরের শেষ তিন মাসে এই অর্থের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
তবে এই প্রবৃদ্ধিতে সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ দেখছেন না বিশ্লেষকরা। কারণ, ২০২০ সাল নাগাদ ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৬ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অথচ এখন পর্যন্ত এই হার ২২ শতাংশেই আটকে আছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোর জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে সরকারের পূর্বের ঋণ পরিশোধ। বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ তো নিচ্ছেই না, উল্টো প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে গত ৯ মাসে। অথচ চলতি অর্থবছরের জন্য সরকার ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা ধার নেয়ার ঘোষণা ছিল বাজেটে। উচ্চসুদের সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭০ ভাগ বেশি ঋণ আসায় আপাতত ব্যাংকবিমুখ সরকার।
এদিকে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যাংকগুলোকে বারবার তাগাদা দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘ব্যাংক ঋণ বিতরণ করতে ব্যর্থ হলে এর দায় ব্যাংকগুলোকেই নিতে হবে’- এমন কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। তিনি আশার বাণী শুনিয়ে বলেন, ‘মুদ্রানীতির লক্ষ্যগুলো অর্জনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ঋণপ্রবাহ আরো বাড়বে।’



 

Show all comments
  • রাজ্জাক ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ৩:৫৪ এএম says : 0
    দেশে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঋণ

৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৯ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ