পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর গত ছয়-সাত মাস ধরে যে অকল্পনীয় হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন-নির্যাতন চলছে, তা বিশ্বের কারোই অজানা নয়। মিয়ানমার সরকারের এই জাতিবিনাশী কার্যক্রমের মধ্যেই দেশটির নেত্রী অং সান সূচি বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে মুসলমানরাই মুসলমানদের জাতিগতভাবে নিধন করছে। শান্তিতে নোবেল জয়ী একজন নেত্রীর এমন ঢাহামিথ্যা ও নিষ্ঠুর কথা বলতে একটুও দ্বিধা হয়নি। অকপটেই তিনি বলে গেছেন, রাখাইন রাজ্যে যথেষ্ট বৈরিতা রয়েছে, মুসলমানরাই মুসলমানদের হত্যা করছে। এমন অবিশ্বাস্য কথা একজন নেত্রী যিনি আবার গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা ব্যক্তি, কী করে বলেন, তা বোধগম্য নয়। এমন কথা শুধু মানবতাহীন মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব। বিবিসি তাকে প্রশ্ন করেছিল, মানবাধিকার রক্ষার দূত এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী হয়েও তিনি ব্যর্থ হয়েছেন নিজ দেশের রোহিঙ্গাদের নির্মূলে বাধা দিতে- তখন তিনি তা সযতনে প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। তার এই এড়িয়ে যাওয়া থেকেই বোঝা যায়, তিনি পুরো বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এবং তার সরকারের অধিনেই মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। অং সান সূচির উল্লেখিত বক্তব্য এবং তার ভূমিকা নিয়ে আমাদের নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।
গত বছরের অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গাদের উপর দেশটির সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সমন্বিত যে নিধন কার্যক্রম চলছে, তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নিরস্ত্র ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের নৃশংসভাবে হত্যা, বাড়িঘর পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া এবং পলায়নপরদের উপর পাখির মতো গুলিবর্ষণ করে হত্যার চিত্র বিবেকবান প্রত্যেক মানুষকে মর্মাহত করলেও অং সান সূচির বিন্দুমাত্র বিচলন বা শোচনা হয়নি। তিনি নির্বিকারভাবে এসব হত্যাযজ্ঞ অবলোকন করেছেন। বিদেশ সফরকালে সে সময় তাকে প্রশ্ন করা হলে, তিনি দারুণ বিরক্তি প্রকাশ করেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ক্ষমতার বাইরে থাকতে তার সংগ্রাম ও মানবাধিকারের বিষয়টি ছিল পুরোই লোক দেখানো। তাকে অবিসংবাদিত নেত্রী বলার বিষয়টি ছিল ক্ষমতাসীন হওয়ার একটি প্রক্রিয়া মাত্রা। তা নাহলে ক্ষমতায় এসে তিনি কেন নিজ দেশের একটি জাতিগোষ্ঠীর উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও সমূলে উৎসাদন করার মতো মানবতাবিরোধী অপকর্মকে সমর্থন করবেন। এখন আবার রোহিঙ্গারাই রোহিঙ্গদের হত্যা করছে এমন অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিলেন। জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনকে মানবতাবিরোধী অপরাধ বলে বারবার বলছে, তা কি অসত্য? আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গা নিধন চলাকালে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের তদন্ত কমিটিকে ঘটনাস্থলে যেতে দেয়া হয়নি। তাদের ফিরে আসতে হয়েছে। কোনো সংবাদ সংস্থাকে সঠিক চিত্র তুলে ধরতে রোহিঙ্গা এলাকায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত রোহিঙ্গদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে বিশাল সমাবেশ করেছেন। সেখানে সুস্পষ্টভাবেই রোহিঙ্গা নির্মূলে মিয়ানমার সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। বাংলাদেশ, চীন, থাইল্যান্ড পলায়নপর অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এসব কি অং সান সূচি দেখেননি? তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করার জন্য বিশ্বব্যাপী যে দাবি উঠেছিল, তা কি এমনি এমনি করা হয়েছিল? এ কথা এখন নিশ্চিত করেই বলা যায়, অং সান সূচি কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য, তার দেশের একটি জাতি গোষ্ঠী নির্মূল কার্যক্রমকে সমর্থন করছেন। অথচ তিনি যখন বন্দি ছিলেন, তার মুক্তির জন্য এই রোহিঙ্গারাও অন্য সব নাগরিকদের মতো আন্দোলন করেছিল। তার প্রতিদান কি তিনি বুলেটের মাধ্যমে দিলেন? আমরা দেখেছি, সিরিয়া, লিবিয়া থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদের নাগরিকরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। দেশগুলো তাদের আশ্রয় এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। অথচ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা আদি বাসিন্দা হওয়া সত্তে¡ও দেশটির সরকার তাদের কোনোভাবেই মানতে নারাজ। তাদের সমূলে বিনাশ করার প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ায় মিয়ানমার সরকার এই নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্য জাতিগোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে থাকলেও তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, মিয়ানমার সরকার বর্ণবাদী এবং মুসলিমবিদ্বেষী। অং সান সূচিও তার ঊর্ধ্বে নন।
বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে অং সান সূচি এ কথাও বলেছেন, বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে চলে যাওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ ফিরে আসতে চাইলে তাদের সাদরে গ্রহণ করা হবে। তবে তিনি এ কথা বলেননি, রাখাইনে যে নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে, তা বন্ধ করা হবে। তিনি এ গ্যারান্টি দেননি, দেশে ফেরত গেলে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়, তার এসব কথা কেবল কথার কথা। তার কথায় রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। আমরা মনে করি, মিয়ানমার নেত্রীকে আন্তরিকতার সাথে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধানে দায়িত্বশীল উদ্যোগ নিতে হবে। রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারের নাগরিক এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্য যেসব নাগরিক যেভাবে মিয়ানমারে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, রোহিঙ্গাদেরও অনুরূপ সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গারা যাতে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারে, এ নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কেও এ ব্যাপারে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। কেবল লিপ সার্ভিস দিয়ে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।