পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া, খুন, গুম, একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান ও অভিযান পরিচালনা সংক্রান্ত খবরা-খবরে গত কয়েক দিনে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর হদিস না পাওয়া এবং পরবর্তীতে লাশ পাওয়ার ঘটনায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। এর সঙ্গে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান এবং অভিযানের বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে। মানুষের মধ্যে এক ধরনের অনিরাপত্তাবোধ বিস্তৃত হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ১০ দিনে অন্তত ১৪ জনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে তুলে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক নূরুল আলম নূরুর হাত ও চোখ বাঁধা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। বাকিদের কোনো খোঁজ নেই। স্বজনরা থানা-পুলিশের কাছে গেলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, তারা কিছু জানে না। এদিকে আইন ও শালিস কেন্দ্রের এ বছরের প্রথম তিন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাব ও পুলিশের গুলিতে ৪৪ ব্যক্তি নিহত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে ১৯৫ জন। অবশ্য বরাবরের মতোই এ প্রতিবেদন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অস্বীকার করেছে। সরকারও বলছে, দেশে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকান্ড নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব হত্যাকান্ড তাহলে কীভাবে ঘটছে? কেমন করে দিনের পর দিন মানুষ উধাও হয়ে যাচ্ছে? এসব প্রশ্নের যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। এ কারণেই জনমনে চরম আতঙ্ক দানা বেঁধেছে।
যে পরিবারের এক বা একাধিক মানুষকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় এবং কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না, সে পরিবারের অবস্থা কী হয়, তা বোধ করি ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একে তো স্বজন হারানোর বেদনা, তার উপর থানা-পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার না পাওয়ায় এক দুঃসহ পরিস্থিতিতে তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য তুলে নিয়ে গেছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেও বিপদে পড়তে হয়। পরিবারের উপর নানাভাবে হুমকি ও চাপ আসে। অর্থাৎ স্বজন হারিয়ে তারা যেমন শোকে কাতর হয়ে পড়ে, তেমনি অভিযোগ করেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। অথচ এসব ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা। আমরা দেখছি, এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিস্পৃহ। স্বপ্রণোদিত হয়ে যে তাদের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার কথা, তা দেখা যায় না বললেই চলে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ ও আকুতিতে সরকারেরও তেমন কোনো সাড়া নেই। কোনো নাগরিক নিখোঁজ হলে তাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকার ও তার প্রশাসন যন্ত্রের। আমরা দেখছি, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কেউ যদি অপরাধ করে এবং কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে, তবে তাকে গ্রেফতার করার সুনির্দিষ্ট আইন-কানুন রয়েছে। উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। তারপরও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বরং দিন দিন সাদা পোশাকে এবং বিনা ওয়ারেন্টে তুলে নেয়া, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বেড়ে চলেছে। প্রতিকারহীন এই অপসংস্কৃতি বিস্তার লাভের ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। কে কখন অপহরণ, গুম, খুনের শিকার হয়ে যাবে- এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
পরিস্থিতি এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, স্বাভাবিকভাবে মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যখন-তখন যে কাউকে তুলে নেয়ার বিষয়টি মামুলি ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে বহুদিন ধরেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অভিযোগ অস্বীকার করে দায়মুক্তির চেষ্টা করছে। ভাবছে না, এ ধরনের অভিযোগ কেন তার বিরুদ্ধে উঠবে? অভিযোগ করা হলেও তা তদন্ত করে কেন প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বার্থেই তো প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে প্রতিকার করা উচিত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্য যদি জড়িত থাকে, নিজ ভাবমর্যাদা রক্ষার স্বার্থে তা প্রকাশ করে সত্য উন্মোচন করা দরকার। কেবল অভিযোগ উঠবে আর অস্বীকার করা হবে- এ প্রবণতা চলতে থাকলে প্রকৃত অপরাধীরা কোনো দিনই ধরা পড়বে না। জনমনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে অপহরণসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের প্রতিটির সঠিক তদন্ত এবং দোষীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর হাহাকার দূর করা এবং নতুন করে আর কোনো পরিবারের সদস্য যাতে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমর্যাদা রক্ষা এবং উজ্জ্বল করার স্বার্থেই তা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, এসব ঘটনায় যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জড়িত থাকে, তবে তাকে একদিন না একদিন জবাবদিহি করতেই হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।