পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে মানুষকে তুলে নেয়ার ঘটনা বেড়েই চলেছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো তুলে নেয়া স্বজনদের যেমন ফিরে পাচ্ছে না, তেমনি এর কোনো প্রতিকারও পাচ্ছে না। কখনো কখনো অপহৃতদের লাশ যেখানে-সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। কে কখন অপহরণের শিকার হবে, তা জানে না। এমনকি এক নির্মম ও দুঃসহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ দিনে দেশের চার জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে কমপক্ষে ১২ জনকে তুলে নেয়ার সংবাদ গতকাল বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহে পাঁচজন, চট্টগ্রামে এক পরিবহন ব্যবসায়ী ও তার দুই শ্যালক, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে তিন যুবক, রাজশাহীর বাগমারা থেকে একজন, সাতক্ষীরাস্থ কলারোয়া থেকে দুই ভাই এবং চট্টগ্রাম নগরীর বাসা থেকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পদককে তুলে নেয়া হয়। এর মধ্যে ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদকের লাশ হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় কর্ণফুলী নদীর পাড়ে পাওয়া যায়। অপহৃতদের পরিবার জানিয়েছে, তাদের র্যাব, পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে। স্বজনরা থানায় খোঁজ নিতে গেলে বলা হচ্ছে, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানে না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কারা তাদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে? র্যাব, পুলিশ যদি তুলে না নিয়ে থাকে, তবে তাদের দায়িত্ব অপহৃতদের খুঁজে বের করা। যেহেতু তাদের পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাই তাদের ভাবমর্যাদা রক্ষার্থে অপহৃতদের উদ্ধার করা এবং এর পেছনের হোতাদের গ্রেফতার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া তাদের জরুরি কর্তব্য।
বিগত কয়েক বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা দেখেছি, অপহৃতদের স্বজনরা প্রায়ই সংবাদ সম্মেলন করে তাদের স্বজনদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আকুল-আবেদন করছে। তাদের কান্নায় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের ন্যূনতম দাবি, নিদেন পক্ষে এই সংবাদটুকু দেয়া হোক, তারা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। মৃত্যু হলে লাশটি যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়। এ ধরনের আকুতি হৃদয়বান প্রতিটি মানুষকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতির মধ্যেই হঠাৎ করে যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে অপহরণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাও এমন এক সময়, যখন দেশে একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযান চলছে। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে উৎকণ্ঠার। আমরা জানি না, যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে লোকজন তুলে নিচ্ছে, তারা সত্যিকার অর্থে এ বাহিনীর সদস্য কিনা। তবে অপহৃতদের পরিবার যখন দাবি করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়েছে, তখন তা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম থাকে। কারণ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক সাদা পোশাকে তুলে নেয়ার ঘটনা অহরহই ঘটছে। এমন ঘটনাও রয়েছে, তুলে নেয়ার পর অপহৃত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। অথচ উচ্চ আদালতের স্পষ্ট রায় রয়েছে, সাদা পোশাকে বা বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। আমরা দেখছি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য তার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে। আদালতের রায় থোড়াই কেয়ার করছে। বরং দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। এটা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমর্যাদার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘসহ বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে এবং এখনও করছে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের ঘটনা নিয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দেশের আইনে গুমের স্বীকৃতি না থাকায় এবং তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় জাতিসংঘ উচ্চমাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্তব্য করেছে, এর অর্থ হচ্ছে, দেশে গুম, খুনের ঘটনা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব ঘটনা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে যে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে গুম ও অপহরণের এসব ঘটনার দায় তাদের উপরই এসে পড়ছে। এর উপর যখন, অপহৃতদের স্বজনরা থানায় যায়, তাদের বলা হচ্ছে থানা-পুলিশ কিছু জানে না। ঘটনা সম্পর্কে থানা-পুলিশ নাও জানতে পারে, তবে জানার পর কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না, তা প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর সংশ্লিষ্ট থানায় একসঙ্গে একাধিক ব্যক্তি অপহৃত হবে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গোচরীভূত হবে না, এটাও বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মাণ হয় না।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, অপহরণকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী। তবে অপহৃতদের জীবিত উদ্ধার করতে না পারা এবং তাদের লাশ পড়ে থাকা থেকে মনে হচ্ছে, অপহরণকারী চক্র ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এটা কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ বাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব, মানবাধিকার রক্ষা ও শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। এর কেউ যদি অপহরণের মতো কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকে, তবে তা সমাজ ও দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সেখানে যেমন মানবাধিকার বলে কিছু থাকে না, তেমনি এ বাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা বলেও কিছু থাকবে না। আমরা জানি, আজ হোক, কাল হোক- যেসব অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, এর পেছনে যারাই জড়িত থাকুক, তা উদঘাটিত হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হোক বা এ বাহিনীর পরিচয়ে হোক, যারাই জড়িত থাকুক না কেন, তাদের একদিন আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমর্যাদার স্বার্থেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। অপহৃতদের পরিবারের সদস্যদের কান্না যেখানে বিবেকবান মানুষের হৃদয়কে বিগলিত করে, সেখানে আমরা মনে করি, মানবাধিকার রক্ষাকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরও অধিক বিচলিত ও বিগলিত হওয়ার কথা। এ বোধ থেকে অপহরণের মতো মারাত্মক মানবাধিকার হরণ করা অপরাধের সাথে যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রহণ করবে বলে আমরা আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।