Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপসর্গহীন গ্লুকোমা প্রতিরোধ করুন

| প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আমার মামাত ভাই রহমান কোন এক এনজিওর বড় কর্মকর্তা। প্রায়ই দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ান। পয়সার কোনো অভাব নেই। আমাকে দেখলেই বলে তোর কাছে চোখ দেখাতে আসব একদিন। কিন্তু বেচারা ব্যস্ততার কারণে আসতে পারে না। এমন কি বিদেশে গিয়েও চোখ দেখানোর সুযোগ হয় না তার। বয়স ৫৬ বছর। সুন্দর চেহারার অধিকারী কিন্তু ডায়াবেটিস। শুধু তাই নয় তাদের পরিবারের তার মা-খালাদের চোখ গøকোমার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়ার ইতিহাসও আছে। এ সমস্ত কারণে আমি নিজেও তাকে কয়েকবার চোখ দেখানোর জন্য বলেছি। চল্লিশের ঊর্ধ্বে বয়স, ডায়াবেটিস, পারিবারিক গøকোমার ইতিহাস ইত্যাদি গøকোমার সম্ভাবনা একজন ব্যক্তির মাঝে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যাই হোক বহুদিন পর শেষ পর্যন্ত একদিন কোন এক সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে রহমান ভাই এসে হাজির। বলল দেখ গত কিছুদিন ধরে আমি বার বার চশমা বদলাচ্ছি ডাক্তারের কাছে গিয়ে কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না, দৃষ্টির ব্যাপ্তিও আগের চাইতে কেমন যেন কমে গেছে। আমার চোখটা একটু দেখে দে। আমি যথারীতি পরীক্ষা করা শুরু করলাম। দেখলাম তার দূরের দৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে, চশমা দিয়েও তা ঠিক করা যাচ্ছে না। চোখের প্রেসার মাপতে গিয়ে দেখি প্রেসার অনেক বেশি। চোখের সবচেয়ে সংবেদনশীল নার্ভ পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখলাম নার্ভের প্রায় ৮০ ভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে। যাচাই করার জন্য তাকে কিছু উনড়বতমানের পরীক্ষার জন্য পাঠালাম। পরীক্ষার রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত কিছুটা উদ্বিগড়ব ছিলাম কিন্তু দুর্ভাগ্য পরীক্ষার রিপোর্ট বলে দিল ওনার চোখের নার্ভেও ক্ষতির পরিমাণ আমার ধারণার মতোই। বিষয়টা যখন রহমান ভাইকে জানালাম তখন প্রচÐভাবে ভেঙে পড়ল। সেই সাথে ওনার স্ত্রীও। বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগল আমি কি আগের মতো দেখতে পাব না? অমি যদি নিয়মিত ওষুধ দেই তাহলে কি চোখ আগের মতো ভালো হবে না? আমি বললাম ভাই আপনার চোখের গøুকোমা রোগটা মানুষের চোখকে চিরতরে ক্ষতি করে দেয়। যে পরিমাণ ক্ষতি হয়ে গেছে সে পরিমাণ দৃষ্টি আবার ফিরে পাবার কোন সম্ভাবনা নেই, তবে যেটুকু দৃষ্টি আছে ততটুকু দৃষ্টি টিকিয়ে রাখার উপায় আপনার আছে। দৃষ্টি টিকিয়ে রাখতে হলে আপনাকে অবশ্যই নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। ওষুধ ছাড়াও লেজার বা অপারেশনের মাধ্যমে আপনার চোখের প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। অত্যন্ত সুন্দরভাবে তার চোখের অপারেশন সম্পনড়ব করি। এখন তিনি নিয়মিত চোখ দেখিয়ে যান এবং বর্তমানে তার চোখের চাপ অত্যন্ত সুন্দর নিয়ন্ত্রণে আছে। এখন আসুন গøুকোমা সম্পর্কে আমরা একটু বিস্তারিত জেনে নেই।
গøুকোমা কি?
গøুকোমা চোখের একটি জটিল রোগ যাতে চোখের ¯ড়বায়ু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি কমে যায়। এমন কি এতে এক সময় রোগী অন্ধত্ববরণ করতে বাধ্য হয়। তবে সময় মত ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করলে এই অন্ধত্বের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চোখের অভ্যন্তরীণ উচ্চচাপ এর জন্য দায়ী।
গøুকোমা রোগ কেন হয়? এই রোগের সুনির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পাওয়া না গেলেও অদ্যবদি চোখের উচ্চচাপই এই রোগের প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে স্বাভাবিক চাপেও এই রোগ হতে পারে। সাধারণত চোখের উচ্চচাপই ধীরে ধীরে চোখের ¯ড়বায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দৃষ্টিকে ব্যাহত করে। তবে কিছু কিছু রোগের সাথে এই রোগের গভীর সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায় এবং অন্যান্য কারণেও এই রোগ হতে পারে। যেমন : পরিবারের অন্য কোন নিকট আত্মীয়ের এই রোগ থাকা। বয়স চল্লিশ বা তদোর্ধ্ব ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। মাইগ্রেন নামক মাথাব্যথা রাত্রিকালীন উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সেবন করা। স্টেরোইড নামক ওষুধ দীর্ঘদিন সেবন করা। চোখের ছানি অপারেশন না করলে বা দেরী করলে। চোখের অন্যান্য রোগের কারণে। জন্মগত ত্রæটি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র চোখের উচ্চচাপই ওষুধ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব, যা গøুকোমা রোগের প্রধান কারণ।
গøুকোমা রোগের লক্ষণ কি? অনেক ক্ষেত্রেই রোগী এই রোগের কোন লক্ষণ অনুধাবন করতে পারে না। চশমা পরিবর্তনের সময় কিংবা নিয়মিত চক্ষু পরীক্ষার সময় হঠাৎ করেই চিকিৎসক এই রোগ নির্ণয় করে থাকেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নি¤েড়বর লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। যেমন : ১ ঘন ঘন চশমার গøাস পরির্বতন হওয়া ২ চোখে ঝাপসা দেখা বা আলোর চারপাশে রংধনুর মতো দেখা ৩ ঘন ঘন মাথাব্যথা বা চোখে ব্যথা হওয়া ৪ দৃষ্টি শক্তি ধীরে ধীরে কমে আসা বা দৃষ্টির পারিপার্শ্বিক ব্যাপ্তি কমে আসা। অনেক সময় চলতে গিয়ে দরজার পাশে বা অন্য কোন পথচারীর গায়ে ধাক্কা লাগা ৫ মৃদু আলোতে কাজ করলে চোখে ব্যথা অনুভ‚ত হওয়া ৬ ছোট ছোট বাচ্চাদের অথবা জন্মের পর চোখের কর্নিয়া μমাগত বড় হয়ে যাওয়া বা চোখের কর্নিয়া সাদা হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ইত্যাদি
গøুকোমা সম্পর্কে জানা জরুরি কেন?
* আমাদের দেশে এবং পৃথিবীব্যাপী অন্ধত্বের দ্বিতীয় কারণ হলো চোখের গøুকোমা * অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ রোগী বুঝতে পারার আগেই চোখের ¯ড়বায়ু অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে * এই রোগে দৃষ্টির পরিসীমা বা ব্যাপ্তি ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসে এবং কেন্দ্রীয় দৃষ্টি শক্তি অনেক দিন ঠিক থাকে বিধায়, রোগী চিকিৎসকের শরণাপনড়ব হতে অনেক দেরী করে ফেলেন * গøুকোমা চোখের অনিরাময়যোগ্য অন্ধত্ব তৈরি করে। তাই একবার দৃষ্টি যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, চোখে গøুকোমা রোগ হলে রোগীকে সারাজীবন চিকিৎসকের সংস্পর্শে থাকেন না বা ঠিকমত ওষুধ ব্যবহার করেন না। ফলে এই রোগ নীরবে ক্ষতি করে অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।
গøুকোমা রোগের চিকিৎসা কি? গøুকোমা রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব কিন্তু নিরাময় সম্ভব নয়। ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো এই রোগের চিকিৎসা সারাজীবন করে যেতে হবে। এই রোগে দৃষ্টি যতটুকু হ্রাস পেয়েছে তা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। তবে দৃষ্টি যাতে আর কমে না যায় তার জন্য আমাদের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
এ রোগের প্রচলিত তিন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে : ক) ওষুধ এর দ্বারা চিকিৎসা খ) লেজার চিকিৎসা গ) শৈল চিকিৎসা বা সার্জারি। যেহেতু চোখের উচ্চচাপ এই রোগের প্রধান কারণ তাই ওষুধের দ্বারা চোখের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে একাধিক ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। তদুপরি তিন মাস অন্তর অন্তর চিকিৎসকের শরণাপনড়ব হয়ে এ রোগের নিয়মিত কতগুলো পরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। যেমনঃ-
* দৃষ্টি শক্তি পরীক্ষা * চোখের চাপ পরীক্ষা* দৃষ্টির ব্যাপ্তি বা ভিজুয়্যল ফিল্ড পরীক্ষা * চোখের নার্ভ পরীক্ষা।
গøুকোমা রোগে রোগীর করণীয় কি? চিকিৎসক রোগীর চক্ষু পরীক্ষা করে তার চোখের চাপের মাত্রা নির্ণয় করে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করে দেবেন তা নিয়মিত ব্যবহার করা। দীর্ঘদিন একটি ওষুধ ব্যবহারে এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে বা পার্শ্বপ্রতিμিয়া দেখা যেতে পারে তাই নিয়মিত চিকিৎসকের শরণাপনড়ব হওয়া। সময়মত চোখের বিভিনড়ব পরীক্ষা (যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) করিয়ে দেখা যে তার গøুকোমা নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা। পরিবারের সবার চোখ পরীক্ষা করিয়ে গøুকোমা আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। মনে রাখবেন গøুকোমা অন্ধত্বের অন্যতম প্রধান কারণ যার কোন প্রতিকার নেই। প্রতিরোধই একমাত্র উপায়।
তাই ২০১৭ সালে বিশ্ব গøকোমার ¯েøাগান হলো “উপসর্গহীন গøুকোমা প্রতিহত করুন”
ডা. জাকিয়া সুলতানা শহীদ
গøুকোমা বিশেষজ্ঞ, সেμেটারি জেনারেল- বাংলাদেশ গøুকোমা সোসাইটি, সহযোগী অধ্যাপক, চক্ষু বিভাগ, আনোয়ার খান মর্ডান মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, কলাবাগান, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন