Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাদক নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কোন সুযোগ নেই

| প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নিয়ন্ত্রণহীন মাদক বাণিজ্য এবং ক্রমবর্ধমান মাদকাসক্তি ভয়াবহ সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। মাদকাসক্তি ও মাদক বাণিজ্যের কুফল প্রত্যক্ষ করে দেশের সর্বত্র মাদকের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা এবং গণপ্রতিরোধের সামাজিক আন্দোলনও শুরু হয়েছে। অন্যদিকে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহের তরফ থেকেও মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের কার্যক্রম চলছে। এমনকি দেশের সর্বত্র স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা মাদক বিরোধী সামাজিক আন্দোলনের সাথেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা ও একাত্মতা প্রকাশের খবর সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এতকিছুর পরও মাদকের রমরমা বাণিজ্যে কোন ঘাটতি দেখা যাচ্ছেনা। মাদক বিরোধী প্রচারণা ও তৎপরতায় সামাজিক-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা ও শুভঙ্করের ফাঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে ঢাকাসহ সারাদেশের মাদক কেনাবেচার স্পট এবং মাদক পাচারের রুটসহ কোথায় কারা কারা জড়িত তার বিবরণসহ তালিকা প্রকাশিত হলেও বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবে এবং ক্রমবর্ধমান হারে মাদকের কারবার চলে কিভাবে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সার্বজনীন প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা এবং মাদকের নেটওয়ার্ক নির্মূল করা দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে ওঝার পক্ষে ভূত তাড়ানো কঠিন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির প্রভাবশালী থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য এবং স্থানীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে গড়ে উঠেছে মাদকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও সিন্ডিকেট। মাদক বাণিজ্যের কোটি কোটি টাকা প্রতিদিন ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে এই সিন্ডিকেটকে আরো শক্তিশালী ও দুর্ভেদ্য করে তুলছে।
দেশে এখন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন সংঘাত-সহিংসতা না থাকলেও পারিবারিক-সামাজিক অপরাধ ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। চুরি,ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এ ধরনের সামাজিক পরিস্থিতির পেছনে মাদক বাণিজ্য, মাদক সন্ত্রাসী সিন্ডিকেটের সম্পৃক্ততা সুস্পষ্ট। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদী হুমকি ও নেটওয়ার্ক ধ্বংসে জিরো টলারেন্স নীতিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও জঙ্গিবাদের চেয়েও ভয়াবহ ও দৃশ্যমান সামাজিক হুমকি হয়ে ওঠা সত্তে¡ও মাদকের ভয়ঙ্কর নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। মাদক সন্ত্রাসীরা বছরের পর বছর ধরে বাধাহীনভাবে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে করতে এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে খোদ অস্ত্রধারী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর আক্রমণ করতে শুরু করেছে। ফেনী সীমান্তে মাদক ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হয়ে এক আনসার সদস্য নিহত এবং ম্যাজিস্ট্রেট গুরুতর আহত হওয়ার খবর গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। শুধুমাত্র কুমিল্লা ও ফেনি সীমান্তেই দুই শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে মাদক চোরাচালান হচ্ছে বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। গত ৬ মাসে এই সীমান্তে বিজিবি’র হাতে প্রায় ৫৮ কোটি টাকার মাদক আটক হলেও মাদকের ভয়াবহ স্্েরাত মোটেও কমেনি। বাংলাদেশের তিনদিক ঘেরা ভারতের সাথে আড়াই হাজার কিলোমিটার স্থলসীমান্তের শত শত পয়েন্টে সব ধরনের মাদক, আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা ধরনের অবৈধ সামগ্রীর চোরাচালান হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইয়াবাসহ এমফিটামিন জাতীয় মাদকের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কক্সবাজার নৌরুট ও মিয়ানমার সীমান্ত অন্যতম মাদকরুট হয়ে উঠেছে। বলাবাহুল্য, চালান হওয়া মাদকের খুব সামান্যই বিজিবি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পুলিশের সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়, সারা বছর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়া মাদকের পরিমাণ মোট চালান হওয়া মাদকের শতকরা ১০ ভাগের বেশী নয়।
সীমান্তপথে বছরে কোটি কোটি ইয়াবা টেবলেট দেশে প্রবেশ করছে। সেই সাথে খোদ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা তৈরীর কারখানা গড়ে উঠছে। লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ইয়াবা, হেরোইন, সিসা, ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত হয়ে পরিবার ও সমাজকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। এগুলো পুরনো খবর। সর্বশেষ নতুন খবর হচ্ছে, ওষুধের কাঁচামাল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত সিউডো এফিড্রিন নামক শক্তিশালী একটি ড্রাগের দেড় হাজার কেজির বিশাল মজুদ রয়েছে দেশের ৯টি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের হাতে। এর এক কেজি কাঁচামাল দিয়ে চার লাখ ইয়াবা টেবলেট প্রস্তুত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। শত শত কোটি ইয়াবা টেবলেট তৈরীর উপযোগী কাঁচামাল জব্দ ও ধ্বংস না করার ঘটনাও রহস্যজনক। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের মত মাদক চোরাচালানও একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। তবে বিশ্বের দেশে দেশে মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে বিশেষ বাহিনী গঠনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে ধরনের প্রস্তুতি ও তৎপরতা দেখা যায় বাংলাদেশে নেই। উপরন্তু বাহ্যিকভাবে যতই মাদক বিরোধী প্রচারণার কথা বলা হোক না কেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী সদস্য থেকে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিশাল মাদক সিন্ডিকেটের সাথে জড়িয়ে তারা মাদকের টাকায় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছে। অন্যদিকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযান যেন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মত। প্রতি মাসে লাখ লাখ পিস ইয়াবাসহ কোটি কোটি টাকার মাদক ধরা পড়লেও এর নেপথ্যের হোতারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। আর হাতে নাতে যারা ধরা পড়ছে তারাও পুলিশের দুর্বল চার্জশিটের সুযোগে জামিন নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অথবা আইন-শৃঙখলা বাহিনীকে ম্যানেজ করে মাদক ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছে। মাদকের সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় সারাবিশ্বেই মাদক চোরাচালানের মত অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তির আওতাভুক্ত। পত্র-পত্রিকায় মাদকের নেটওয়ার্ক ও সিন্ডিকেট সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যাবলী প্রকাশিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও তাদের তথ্য রয়েছে এবং মাঝে মধ্যে অনেকে ধরাও পড়ছে। কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় তা’ কমছেনা। সীমান্তে বিজিবি এবং দেশের অভ্যন্তরে র‌্যাব-পুলিশ মাদক চোরাচালান ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির বাস্তবায়ন না করলে মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন