দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মোহাম্মদ খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী : আজ ৯ মার্চ মরহুম মাওলানা এম এ মান্নানের জন্মবার্ষিকী। তিনি ১৯৩৫ সালের এই দিন এক সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মহান পিতা প্রখ্যাত সুফী সাধক মাওলানা শাহ মোহাম্মদ ইয়াছীন (রহ) ছিলেন ফুরফুরা শরীফের পীর হজরত মাওলানা শাহ আবু বকর সিদ্দিকী (রহ)-এর বিশিষ্ট খলিফা।
শুনেছি মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) নাকি বলতেন, তাঁর জন্ম পবিত্র জিলকদ মাসে। জীবদ্দশায় তাঁর জন্ম দিবস পালন করাকে তিনি পছন্দ করতেন না। এ কারণে ওফাতের পূর্বে তাঁর জন্মদিন, জন্মবার্ষিকী কখনো উদযাপিত হয়েছে বলে এই লেখকের জানা নেই। তবে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ)-এর ওফাতের পর প্রতি বছর তাঁর ওফাত বার্ষিকী নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে। মাত্র এক মাস আগেও ৬ ফেব্রæয়ারি তাঁর ওফাতবার্ষিকী পালিত হয়েছে।
ইসলামী ক্যালেন্ডার মিলিয়ে দেখা গেছে যে, ১৯৩৫ সালের ৯ মার্চ মোতাবেক পবিত্র জিলহজ মাসের তিন তারিখ রোজ শনিবার। চান্দ্র হিজরী সালের এ ইসলামের ইতিহাসে নানা দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত এবং এ মাস বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইসলামের অন্যতম হজের মাস এটি এবং কোরবানিও এ মাসের পবিত্র প্রতীকী নিদর্শন।
খাঁটি মোমেন মুসলিমের কোরবানি বা আত্মত্যাগের মাস জিলহজ। এর প্রভাব বৈশিষ্ট্য মাওলানা এম এ মান্নান (রহ)-এর কর্মজীবনের নানা ক্ষেত্রে কিভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল তা বিশ্লেষণযোগ্য। তাঁর সমগ্র জীবন ৭১ বছর বা সাত দশকের অধিক। তাঁর শৈশব-কৈশোর এবং অধ্যয়ন জীবন বাদ দিলে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূত্রপাত। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন, প্রসার ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত করার জন্য মাওলানা মান্নান (রহ) নিয়মতান্ত্রিকভাবে সংগ্রাম সাধনা ও কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি সুদীর্ঘকালের খাঁটি আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিকে নবপর্যায়ে সানন্দে গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন এবং তা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছেন।
মাদ্রাসা শিক্ষা ও আরবী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ)-এর আত্মত্যাগের যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব হলে আন্দাজ করা যাবে তাঁর অনবদ্ধ অবদানের গুরুত্ব কত ব্যাপক। তাঁর অপূর্ব কর্মকৌশল, বিস্ময়কর দক্ষতা, সাংগঠনিক পারদর্শিতা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-ভাবনা ও দূরদর্শিতা সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা নস্যাৎ করে তিনি লক্ষ্য অর্জনে অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যান।
একজন দক্ষ ও সংগঠক হিসেবে মাওলানা মান্নানের একক ভূমিকা এক প্রকারের প্রাণহীন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদারের্ছীনকে মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর শিক্ষক সংগঠনে পরিণত করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষকদের এত বড় ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী সংগঠনে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের সম্মানিত শিক্ষকদের অভাব না থাকলেও জমিয়ত পর্যায়ে তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং একতাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়েছেন তাঁর অপূর্ব কর্মকৌশল ও বিচক্ষণতা গুণে। এক্ষেত্রে তাঁর সাংগঠনিক তৎপরতার তুলনা হয় না।
স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৬ সালের ১৬ জুলাই জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। এদিন থেকে মাদ্রাসা শিক্ষক ও মাদ্রাসা শিক্ষার নবযুগের সূচনা হয় এবং মাদ্রাসা শিক্ষক সমাজ এক ডায়নামিক নেতৃত্বে অগ্রযাত্রা শুরু করেন। এদিন বায়তুল মোকাররমে অনুষ্ঠিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের এক সভায় সর্বসম্মতভাবে মাওলানা এম এ মান্নান (রহ)-কে জমিয়াতের পুন: সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে এ সংগঠন পরিচালনা, এগিয়ে আসেন তাঁর সহায়তায় বহু সংখ্যক নিবেদিতপ্রাণ উলামা নেতৃবর্গ, মাশায়েখ এবং সংগঠন কর্মী। ২৪ আমতলী, মহাখালীতে প্রতিষ্ঠিত হয় জমিয়াতের কেন্দ্রীয় অফিস এবং এখান থেকে নানা কর্মসূচি গৃহিত হয়। প্রথম কর্মসূচিতে যেসব দফা ছিল তা নি¤œরূপ :
(১) শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদার কর্মসূচি;
(২) বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশন গঠন;
(৩) ইবতেদায়ী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা;
(৪) ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন;
(৫) ঢাকার অদূরে মসজিদ প্রতিষ্ঠার জন্য জমিন ক্রয়;
(৬) পানি ও বিদ্যুৎকর মওকুফ;
(৭) জুম্মাবারকে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঘোষণা করা;
(৮) ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা;
(৯) জমিয়াত কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা;
(১০) ইসলামী ছাত্র পরিষদ গঠন প্রভৃতি।
মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) জমিয়াতের এ বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার সংগঠনের কর্মী বাহিনীকে নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হন এবং এ জন্য তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যার বিশদ বিবরণ এখানে সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালের ১৩ ও ১৪ মে তারিখে সরকারের নিকট উল্লেখিত দাবি-দাওয়া পেশ করার প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো মাদ্রাসা শিক্ষকদের এক মহাসম্মেলন শেরেবাংলা নগরের সংসদ ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের ফলশ্রæতিতে ৪৫/৫০ ও ৬৫ টাকা থেকে ৭০/১০০ টাকায় উন্নীত হয় মাদ্রাসা শিক্ষকদের ভাতা। এই সঙ্গে অব্যাহত থাকে অধিকতর অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টা।
অতঃপর মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অবশেষে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বেসরকারি) ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (মাধ্যমিক) এই তিনটি সমিতির সমন্বয়ে ১৯৭৮ সালের মে মাসে গঠিত হয় বাংলাদেশ শিক্ষক ফেডারেশন এবং মাওলানা এম এ মান্নানকে এ ফেডারেশনের কনভেনার নির্বাচিত করা হয়। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন গঠনের মধ্য দিয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হন। বিভিন্ন স্তরের নানা মতাদর্শের শিক্ষকমন্ডলীকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সকলের দাবি- দাওয়া আদায়ের আন্দোলন প্রয়াসের সাফল্য মাওলানা মান্নানের মতো সুদক্ষ ও দূরদর্শী নেতৃত্বেরই ফসল। মাদ্রাসা পড়–য়া এ নেতার নেতৃত্বে বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকমন্ডলী যাদের সংখ্যা মাদ্রাসা শিক্ষকদের তুলনায় বহু গুণে বেশি- সকলে সমবেত হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। মাওলানা মান্নানের নেতৃত্বের বদৌলতেই তাদেরও অনেক দাবি- দাওয়া পূরণ হয়েছিল এবং অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে।
ফেডারেশন গঠিত হওয়ার পর এর মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য বেতন স্কেল ও চাকরিবিধি প্রবর্তন। মূলত পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ফেডারেশনের প্লাটফর্ম থেকে প্রথম আন্দোলন আরম্ভ হলেও দুটি দাবি ছিল প্রধান : (১) সমযোগ্যতাসহ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের অভিন্ন বেতন স্কেল প্রবর্তন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রবর্তন। (২) যুগ যুগ ধরে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা তথা তাদের চাকরি থাকা না থাকা যে কর্তৃপক্ষের খেয়াল খুশির ওপর নির্ভরশীল ছিল যে সার্ভিস রুলের অভাবে সে সার্ভিস রুল প্রবর্তন ১৯৭৯-এর মার্চ মাসে সারাদেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ একদিনের টোকেন স্ট্রাইক পালন করেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালের জুলাই হতে সরকার শিক্ষকদের বেতন স্কেলের আপাতত ৫০ শতাংশ টাকা প্রদান করবেন এবং ১৯৮১ সালের জুন মাসে ১৭ মাসের এরিয়ার একসাথে প্রদান করা হবে বলে প্রতিশ্রæতি দিলেন। এভাবে সরকার ও ফেডারেশনের মধ্যে এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরিশেষে ১৯৮১ সালের জুন মাসের মধ্যে একসাথে ১৭ মাসের টাকা প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয় এবং বেসরকারি শিক্ষকগণ একসাথে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতে পেয়ে যান। এটি ছিল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ)- এর নেতৃত্বে পরিচালিত ফেডারেশনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
স্বায়ত্তশাসিত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠনের পুরাতন দাবি আদায়ের আন্দোলন পুনরায় আরম্ভ করেন মাওলানা এম এ মান্নান জমিয়াতের মাধ্যমে। এর ফলে ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ড ১৯৭৮ নামে এক সরকারি অধ্যাদেশের বলে বাংলাদেশ মাদ্রাসা এডুকেশন বোর্ড স্থাপিত হয় এবং একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে ১৯৭৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। এ বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছিলেন মুহাম্মদ বাকীবিল্লাহ খান। এটি ছিল ছারছীনার মরহুম পীর ছাহেব ও মাওলানা এম এ মান্নানের ঐতিহাসিক বিজয়।
মাওলানা এম এ মান্নানের কীর্তিমালার মধ্যে রয়েছে মসজিদে গাউসুল আজম, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন শিক্ষক কমপ্লেক্স, কাদেরিয়া পাবলিকেশন এন্ড প্রডাক্টস লিঃ এবং সুবিখ্যাত দৈনিক ইনকিলাব প্রতিষ্ঠা করা, যেখান থেকে এটি প্রকাশিত হয়ে আসছে। মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) এর এসব অমর কীর্তির প্রতিটির স্বতন্ত্র ভ‚মিকা রয়েছে, যা এখানে উল্লেখ করার সুযোগ নেই।
একজন অনলবর্ষী বক্তা ও বহু ভাষাবিদ হিসেবে মাওলানা মান্নান সুপরিচিত। যারা মসজিদে গাউসুল আজমে প্রতি জুমাবারে তার ঐতিহাসিক খুতবাগুলো শ্রবণ করেছেন তারা স্বীকার করবেন যে, তিনি কত উঁচু স্তরের খতীব ছিলেন। জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সন্ধানে পুস্তকের প্রকাশিত প্রথম খন্ড তার খুতবা সংকলনের একাংশ মাত্র। অপর খন্ড ও প্রকাশের পথে বলে জানা যায়।
মাওলানা মান্নান সাহেবের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান এই যে, মধ্যপ্রাচ্যের তথা আরব বিশ্বে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনকে পরিচিত করা, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর যে সব আরব দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করতঃ ঢাকায় তাদের দূতাবাস স্থাপন করে সেসব দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত ও বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তি মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাওয়াত করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন এবং তাদের নিকট বাংলাদেশ ও জমিয়তের সঠিক পরিচিতি তুলে ধরেন। উদাহরণস্বরূপ মিশর, লিবিয়া, সউদী আরব, ইরাক, ফিলিস্তিন প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এপর্যায়ে আমরা ঢাকাস্থ সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতীবকে ১৯৭৭ সালের ২৫ অক্টোবর কারিগরি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের পক্ষ হতে আরবীতে প্রদত্ত সুদীর্ঘ মানপত্রের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও জমিয়াতের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিল। তাছাড়া প্রকল্প আকারে আরবী ইংরেজিতে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ঢাকাস্থ আরব দূতাবাসগুলোতে এবং আরবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের দিকে জমিয়াতের এসব প্রচারধর্মী ভূমিকা আরব বিশ্ব ও নবস্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন জোরদার ও সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে। এতদ্ব্যতীত মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে দেশের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। ধর্ম ও ত্রাণ মন্ত্রী হিসেবে সরকারে থাকাকালে নানা ক্ষেত্রে তার বর্ণিত ভ‚মিকা প্রশংসিত ও দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। বিশেষত: প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে ত্রাণ তৎপরতা জোরদারকল্পে ইরাক সরকার হেলিকপ্টার সরবরাহ করেছিলেন মাওলানা এম এ মান্নানেরই আহ্বানে, যা আরব বিশ্বে তার ব্যক্তিগত প্রভাবেরই প্রতিফলন। মধ্যপ্রাচ্যের আরো নানা দেশের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে মাওলানা মান্নান ও তার সংগঠনের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভ‚মিকা মূল্যায়নযোগ্য। বিশেষত: মন্ত্রী হিসেবে তো তার সরকারী ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেও চলে। মোটকথা আরব বিশ্বে তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব।
আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) জীবনে বহুবার হারামাইন শরীফাইনের জিয়ারতসহ পবিত্র হজ উমরাহ পালনের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। তারই সফর সঙ্গী হিসেবে তাঁর ভক্ত অনুরক্ত আছেন বুদ্ধিজীবী এবং ইসলামী চিন্তাবিদ প্রভৃতি শ্রেণীর অনেকেই অনুরূপ সৌভাগ্যর অধিকারী হন। এক্ষেত্রে তাঁর উদারতা ও বদান্যতার কথাও স্মরণ করতে হয়। তাছাড়া তারই বদৌলতে অনেকে তার সঙ্গে থেকে বিভিন্ন মুসলিম দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পবিত্র স্থান ও নিদর্শননাবলী পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সঠিক পরিচিতি তুলে ধরেছেন এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচারকারীদের বিভ্রান্ত চক্রান্তও বানচাল করে দিয়েছেন। এক কথায় তার ব্যাপকভাবে আরব বিশ্ব সফর এবং বহু আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি হিসেবে যোগদান ও আরবীতে বক্তব্য উপস্থাপন আলাপনে বাংলাদেশের সাথে আরবদের সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করা হয়।
আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে যে, বঞ্চিত উপেক্ষিত মাদ্রাসা শিক্ষা ও শিক্ষক-কর্মচারী ভাগ্য উন্নয়নের প্রচেষ্টার ন্যায় অবহেলিত উপেক্ষিত ইসলামের মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) গুরুত্বসহকারে নজর রেখেছেন। আমরা স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা শিক্ষকদের কথা বলছি। তিনি ধর্ম ও ত্রাণ মন্ত্রী থাকাকালীন তাদের সমস্যা সমাধানে এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা ছাড়াও জমিয়াতের মাধ্যমে সর্বদা বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এতদ্ব্যতীত তিনি ধর্মমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৮ সালে মসজিদের খুৎবা সংস্কারে এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং সকল মতাদর্শের সকলের মান্যগণ্য বিশিষ্ট উলামা ফকীহগণের একটি খুতবা রচনা কমিটিও গঠন করেছিলেন। কিন্তু কমিটি তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি।
বহুমুখী প্রতিভাগুণের অধিকারী পীর পরিবারের কৃতীসন্তান আলহাজ্ব মাওলানা এম এ মান্নান (রহ) ছিলেন একাধানের সুদক্ষ শিক্ষক, মোহাদ্দেস, মোফাসসের, সভ্যভাষী খতীব, বক্তা, মাদ্রাসা শিক্ষা শিক্ষকদরদী, দূরদর্শী অভিভাবক, সুদক্ষ পরিচালক সংগঠক, মানবতাবাদী সমাজ সেবক, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং জনপ্রিয় আলেমে দ্বীন। একজন তরিকত মন্ত্রী খাঁটি পীর মাশায়েখ ভক্ত একান্ত সাধক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন শরীয়ত ব্যতীত মারেফাত, তরিকত ও তাছাউফ হয় না। এমনকি সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্মের ওপর নানা দিক থেকে ব্যাপক আলোচনা ও মূল্যায়ন আবশ্যক। খ্যাতিমান পন্ডিত মনীষীদের ওফাত ও মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন করা একটি স্বীকৃত রেওয়াজ। এরূপ দৃষ্টান্তের ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে যে, অনেক গুণী ব্যক্তিত্বের জীবন চরিত তাদের জীবদ্দশাতেই রচিত হয়ে যায় কিংবা তাঁর আত্মকাহিনী রচনা প্রয়োজন। কিন্তু প্রচার বিমুখ মাওলানা আবদুল মান্নান (রহ) তার কিছুই করে যাননি, অথচ তার ছিল অত্যন্ত জোরালো প্রচার মাধ্যম ও শক্তিশালী সংগঠন। ইচ্ছা করলে তিনি এ বিষয়ে অনেক কিছু করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সর্বদা নিজেকে সচেতনভাবে আত্মপ্রচারণা হতে দূরে রেখেছেন।
একথা সত্য যে, মরহুম মাওলানা এম এ মান্নানের ওফাতের পর থেকে প্রতিবছর তাঁর ওফাত বার্ষিকী উদযাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু তাঁর জন্মবার্ষিকী কবে তা আমরা অনেকেই জানি না। মরহুম মাওলানার ওফাত বার্ষিকীর ন্যায় জন্মবার্ষিকী পালনের গুরুত্ব ও প্রয়োজন এখন সময়ের আবেদন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।