পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শিল্প-বাণিজ্য, আবাসিকসহ সব খাতে আবার বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম। এবার দুই দফায় এ দাম বাড়ানো হলো। ১ মার্চ থেকে আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা ও এক চুলার জন্য ৭৫০ টাকা এবং ১ জুন থেকে দুই চুলা ৯৫০ টাকা ও এক চুলা ৯০০ টাকা করা হয়েছে। এই মূল্য ৪৬ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। এক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই গ্যাসের দাম ৫ গুণ বৃদ্ধি পেল। গ্যাসের এই দাম বৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। বৃহত্তম রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি এ মূল্য বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক ও গণবিরোধী আখ্যা দিয়ে অবিলম্বে তা বাতিলের দাবী জানিয়েছে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেছেন, গ্যাসের দামবৃদ্ধি নিয়ে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে সরকার কোনো যুক্তি দেখাতে পারেনি। এই মূল্যবৃদ্ধি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে আদালতে যাবে বলে জানিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে একমাত্র সরকার ছাড়া দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ তীব্র বিরোধিতা করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার যে স্বপ্ন তা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত অত্মঘাতী এবং নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
সরকারের তরফ থেকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির একটিই যুক্তি অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়। এই রাজস্ব আদায় শিল্প খাত, রফতানি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সাধারণ মানুষের উপর কী অসহনীয় দুর্দশা সৃষ্টি করবে, তা বিবেচনায়ই নেয়া হয়নি। আমরা জানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেলে এসব ক্ষেত্রে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে। সরকারের এ ধরনের উদ্যোগকে এক কথায় জনগণের উপর জুলুম ছাড়া কিছুই বলা যায় না। জনগণকে জিম্মি করে তাদের পকেটের পয়সা বের করে নেয়াই যেন সরকারের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কোনো জনবান্ধব সরকারের কাজ হতে পারে না। অথচ ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার পাহাড় জমে আছে। এগুলো কাজে লাগানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে জনগণের পকেট থেকে কীভাবে অর্থ কেড়ে নেয়া যায়, সরকার যেন এ নীতি অবলম্বন করে চলেছে। দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি সর্বকালের সবচেয়ে মন্দাবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে। বিনিয়োগে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগের অন্যতম বাধা গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট। অথচ এ দুটোরই চরম আকাল চলছে। এর উপর দাম বৃদ্ধি ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে গ্যাসের উৎপাদনের দিকে যে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন, সেদিকে সরকারের মনোযোগ নেই। গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিন্দুমাত্র সাফল্য নেই। নতুন নতুন গ্যাস কূপ সন্ধান এবং তা থেকে গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গ্যাসের অভাবে সাধারণ মানুষ বিগত কয়েক মাস ধরে কী নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে দিনাতিপাত করছে, তা পত্র-পত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই প্রকাশিত হচ্ছে। চুলায় গ্যাস নেই, রান্নাবান্নার কাজ হচ্ছে না, অথচ মাস শেষে ঠিকই তাদের বিল দিতে হচ্ছে। জনগণের উপর এমন জুলুমবাজি আর কোনো দেশে আছে কিনা, জানা নেই। গ্যাস না দিয়ে টাকা নিয়ে নেয়া শুধু অনৈতিকই নয়, জনগণের সাথে প্রতারণাও বটে। সরকারের এমন অনৈতিক সিদ্ধান্ত জনগণের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কুফল যে সবক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যায়, উৎপাদন খরচ, পরিবহন খরচ বৃদ্ধির কারণে জিনিপত্রের দাম নাগালের বাইর চলে যায়। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে উৎপাদন সক্ষমতা হ্রাস পায়। এসব প্রতিক্রিয়া এর আগেও দেখা গেছে। নতুন করে গ্যাসের যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করা হলো, তার প্রতিক্রিয়া কতটা তীব্র হবে, তা অনুমাণ করা কষ্টসাধ্য নয়। সরকার গ্যাস সংকট মোকাবেলায় এলএনজি আমদানির চেষ্টা করছে। এতে ধাপে ধাপে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে এলএনজিকে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে জ্বালানি বিভাগ সুপারিশ করেছে। জ্বালানি বিভাগের এ ধরনের সুপারিশের কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, বেসরকারি খাতে এলএনজি আমদানিকারকদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ও সুবিধা দেয়ার জন্য, সাধারণ মানুষের উপর গ্যাসের দাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি, ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে কী ধরনের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এবং এর চাপ জনগণের উপর কীভাবে পড়েছে। বেশুমার দুর্নীতির কথাও ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সরকার তার চাপ সামলানোর জন্য তা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। জনগণের সুবিধা হলো কি হলো না বা মরলো কি বাঁচলোÑ এ নিয়ে কোনো বিচলন নেই।
জনবান্ধব সরকারের কাজ হচ্ছে জনগণের জীবনযাত্রা সহজ ও আরামদায়ক করে তোলা। জনগণের কোনো ধরনের তকলিফ হয় এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে সুখ-সাচ্ছন্দ্য বিধানই তার মূল উদ্দেশ হয়ে দাঁড়ায়। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখছি, সরকার যখনই কোনো কিছু সামাল দিতে অপারগ হয়ে উঠেছে, তখনই তার অপারগতা সামাল দেয়ার জন্য জনগণের উপর চেপে বসেছে। এক বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন করতে গিয়ে সরকার যেভাবে জনগণের উপর দাম চাপিয়েছে, তার চাপ ইতোমধ্যে তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এখন গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে আরও চেপে ধরেছে। জনগণ যে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস নেবে, তার কোনো উপায় রাখছে না। গ্যাস সংকট মোকাবেলায় সরকারের যেসব উদ্যোগ নেয়া উচিত, সেদিকে কোনো ধরনের মনোযোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন কূপের সন্ধান, তা থেকে গ্যাস উত্তোলন এবং সুষ্ঠু সরবরাহ ব্যবস্থা- এর কোনো কিছুই সুষ্ঠুভাবে সমাধানে উদ্যোগ নেই। এক অবৈধ সংযোগই আজ পর্যন্ত উৎসাদন করতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের ব্যর্থতার দায় জনগণের উপর দিয়ে চালিয়ে দেয়ার এক ধরনের প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছে। জনসাধারণের স্বস্তির পরিবর্তে কষাঘাতের নীতি অবলম্বন করে চলেছে। আমরা মনে করি, সরকারের এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। জনসাধারণের জীবনযাপন কীভাবে সহজ করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে তাদের যে টেনশনে ফেলে দেয়া হলো এবং শিল্প, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে যে টানাপড়েন সৃষ্টি করা হলো, তা থেকে সরে আসা বাঞ্ছনীয়। আমরা দাবি করছি, অবিলম্বে গ্যাসের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহার করা হোক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।