Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হাটহাজারীতে হারিয়ে যাচ্ছে পুরনো পরিমাপক আড়ি, সেরি ও পাইয়ামালা

| প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আসলাম পারভেজ, হাটহাজারী : আড়ি, সেড়ি ও পাইয়ামালা গ্রামীণ গৃহস্থবাড়ির ধান, চাল, কুড়া ও বিভিন্ন জাতের বীজ পরিমাপের বস্তু। গৃহস্থ পরিবারের এসব বস্তু না থাকলে তাদের বদনাম হতো। এককালে সন্তানদের বিয়ে-শাদীর কথাবার্তা পরিচালনার সময় পরিবারে কত সের কিংবা আড়ি চালের ভাত দৈনিক রান্না করা হতো সে বিষয়টা প্রাধান্য পেত। যৌথ পরিবার আত্মীয়তার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেত। এখন দিন পাল্টে গেছে। যৌথ পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে মানুষের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে।
গৃহস্থবাড়িতে এক সময় কামলা নিতে সে প্রতিবেলায় কত সের চালের ভাত খেতে পারে সে বিষয় জেনে নেয়া হতো। বেশি চালের ভাত খেতে না পারলে তার গায়ে শক্তি থাকে না। আর শক্তি না থাকলে সে কাজ করতে পারে না। সে কথা মানুষ সে সময় চিন্তা করত। আর বেশি চালের ভাত খেতে পারা লোকজনদের চাহিদা ছিল বেশি। যারা ভাত কিংবা অন্যান্য খাবার কম খেতে পারত তাদের কামলা হিসেবে নিতে পারত না। এখন সময় বদলে গেছে। কেউ শারীরিক পরিশ্রম করতে চায় না। আর কেউ পরিশ্রম করলেও অল্প সময়ে সে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে। মানুষের ভাত খাওয়ার অভ্যাসও কমে গেছে। কোনো মানুষ এখন আর পূর্বের মতো তেমন ভাত খেতে পারে না। অবশ্য এখন মানুষ ভাতের পরিবর্তে চা, নাস্তা ও নানা কিছু খাচ্ছে। আর যেসব জিনিস খাচ্ছে তার অধিকাংশই ভেজাল, পচা ও বাসি এবং খাওয়ার অযোগ্য। এসব খাওয়ার খেয়ে মানুষ দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে মানুষ সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকিতেও থাকে।
পাইয়ামালা নারকেলের মালা কেটে তৈরি করা হতো। চার পোয়াতে এক সের। মালা কেটে চার পোয়া করে দিয়ে একসের পরিমাণ করা হতো। সেরি বেত দিয়ে তৈরি করা হয়। বেত শিল্পীরা এই পরিমাপক সেরি তৈরি করত। আর আড়িও বেত দ্বারা তৈরি করা হয়। সেরি দিয়ে পরিমাপ করে ষোল সের দিলে এক আড়ি হয়। বেত দ্বারা আড়ি সেরিতে তৈরি করে অনেক বেত ও বাঁশ শিল্পী জীবিহা নির্বাহ করত। মৌসুমে এই আড়ি সেরির কদর ছিল অত্যধিক। ধান, চাল, কুড়া পরিমাপ করার জন্য প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে আড়ি সেরি ছিল অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। তাছাড়া শিমের বীজ, পেলন, কলাইসহ নানা প্রকার বীজ পরিমাপ করার বস্তু ছিল সেরি ও পাইয়া মালা। নতুন প্রজন্মের অনেকে এসব জিনিস চিনবেও না। বেত দুষ্পাপ্য হওয়ায় এসব জিনিস এখন কেউ তৈরি করে না। আর যারা এসব জিনিস তৈরি করত তারাও অনেকে বেঁচে নেই। এখনকার লোকজন এসব জিনিস তৈরিতে তেমন আগ্রহী নয়। কিংবা এসব জিনিস তৈরির কাজ আর কেউ শিখতেও চাই না। তবে প্রয়োজনের জন্য অনেকে বাঁশ বেতের তৈরি আড়ি সেরির পরিবর্তে টিনের কৌটাকে পরিমাপক হিসেবে ব্যবহার করছে। সেসব পরিমাপকও হারাবার পথে। এ্যানালগ পদ্ধতি সেই পরিমাপ এখন প্রায় ভুলতে বসেছে। এখন প্রযুক্তির আশীর্বাদে ডিজিটাল পরিমাপক আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে অতীতের সেই পরিমাপক জিনিসপত্র এখন কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। যৌথ পরিবারের সংখ্যা গ্রামে এখন শূন্যের কৌটায়। যৌথ পরিবারের অনেকেই কর্মের তাগিদে পৃথক হয়ে নগরীসহ নানা স্থানে বাসা ভাড়া করে বসবাস করছে। দিন বদলের কারনে এখনকার বউ-ঝিরাও যৌথ পরিবারে থাকতে চায় না। প্রায় প্রত্যেকেই পৃথক হয়ে ছোট সংসার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
তাই এখন গ্রামে যৌথ গৃহস্থ পরিবারগুলো বাড়ি-ঘরের সাথে সম্পত্তিও ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। এই ভাগাভাগি করতে গিয়ে সামান্য বিষয়ে ঝসড়া-বিবাদও বাড়ছে। গৃহস্থ বাড়িতে ভাত রান্না করার সময় পরিবারের সদস্যদের সংখ্যানুপাতে পাইয়া মালা দিয়ে চাল পরিমাপ করে দেয়া হতো। শাশুড়িরা পুত্র বধূকে ভাত রান্না করার সময় মটকা থেকে পাইয়া মালা দিয়ে চাল পরিমাপ করে দিত। এখন পাইয়া মালার স্থান দখল করে নিয়েছে টিনের কৌটা। অ্যানালগ পরিমাপক আড়ি সেরিও এখন উঠে গেছে। এসব জিনিস বাজারেও তেমন দেখা যায় না। অবশ্য কোনো কোনো মেলায় এসব জিনিস দেখা গেলেও দাম অত্যন্ত চওড়া। আড়ি, সেরি পরিমাপক নির্মাণের উপকরণ বাঁশ বেত দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় আর পাওয়া গেলেও এসব উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আড়ি সেরির দামও অত্যধিক। আর টিন কেটে এসব জিনিস বিকল্প তৈরি করা যায় বলেও এগুলোর কদর কমে গেছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাটহাজারী

১৮ ডিসেম্বর, ২০২১
২৯ মার্চ, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ