পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। গরুর গোশতের আরেক দফা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন নির্বাহে বোঝার উপর শাকের আঁটির মত হয়ে উঠেছে। সীমান্তে মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান বন্ধে তেমন কোন অগ্রগতি না ঘটলেও গরু আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিশেষত: বাংলাদেশে গরু রফতানির ক্ষেত্রে ভারতের বিজেপি সরকারের কঠোর অবস্থানের প্রভাবে গত দুই বছরে এমনিতেই বাংলাদেশে গরুর গোশতের মূল্য বেড়ে গিয়েছিল। তবে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধের ফলে বাংলাদেশে যতটা বিরূপ প্রভাবের আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা হয়নি। দেশের কৃষক ও খামারিরা গরুর গোশতের চাহিদা পূরণে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। বলাবাহুল্য, প্রোটিন ও কার্বহাইড্রেডের মূল উৎস হিসেবে আবহমান কাল ধরে আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছ। দেশের নদনদী ও খাল-বিল শুকিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ মৎস্য সম্পদের প্রাকৃতিক উৎসগুলো সংকীর্ণ হয়ে পড়ায় মাছের পাশাপাশি গোশতের চাহিদাও বেড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উৎসব ও অতিথি আপ্যায়নে মুরগি ও গরুর গোশত সাধারণভাবে জনপ্রিয় মেনু হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবেশী দেশের হিন্দুত্ববাদী সরকার আইন করে সে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি নব্বইভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার পক্ষেও পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
ভারত গরু রফতানি নিষিদ্ধ করার পর বাংলাদেশে গরুর গোশতের দাম বৃদ্ধিকে তাদের নীতির সাফল্য বলে দাবি করেছিলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধের জন্য নয়, বরং দেশের গরুর হাটগুলোতে এবং গবাদি পশু পরিবহনে নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজির কারণেই গরুর গোশতের মূল্য বেড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা ও আশপাশের হাটগুলোতে যত্রতত্র চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন গোশত ব্যবসায়ীরা। হাঁটে ও রাস্তায় চাঁদাবাজি, ঘাটে ঘাটে হয়রানি, বাড়তি খাজনা ও লাইসেন্স সম্পর্কিত জটিলতা ও হয়রানি বন্ধসহ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে গত ১১ ফেব্রুয়ারী জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে ঢাকার ব্যবসায়ীরা। এসব দাবি-দাওয়া পূরণ হলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে গরুর গোশতের মূল্য অনেকটা কমিয়ে আনার আশ্বাস দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। দাবি আদায়ে তারা ৬ দিনের কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এভাবে ঢাকার ভোক্তারা এক সপ্তাহ গরুর গোশত কিনতে পারেনি। চাঁদাবাজি ও হয়রানি বন্ধের সঙ্গত দাবি আদায়ে কর্মবিরতির টাইমলাইন পেরিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। এ অজুহাতে ব্যবসায়ীরা গরুর গোশতের দাম কেজিপ্রতি প্রায় ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া গরুর গোশতের বাজারে এক কেজি গোশত সর্বোচ্চ ৪২০ টাকা থেকে বেড়ে ৫২০-৩০ টাকায় উঠেছে। চাঁদাবাজিসহ নানাবিধ হয়রানি বন্ধের উদ্যোগ নিয়ে গরুর গোশতের মূল্য যেখানে আরো কমিয়ে আনা সম্ভব, সেখানে ঢাকার বাজারে কেজিতে শত টাকা মূল্যবৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
বৈধ উপায়ে ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকলেও গরু আমদানির নামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাজার কোটি টাকা ভারতে পাচার করছে হুন্ডি সিন্ডিকেট। গতকাল একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে শুধুমাত্র গাবতলি হাটকেন্দ্রিক অর্ধশত হুন্ডি ব্যবসায়ীর তথ্য জানা যায়। এ ক্ষেত্রে সরকার যেমন শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে, পাশাপাশি ঘাটে ঘাটে পুলিশ ও স্থানীয় ইজারাদারদের চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত খাজনা আদায় এবং গোশতের দোকানের লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গরু প্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা অতিরিক্ত খরচ করতে বাধ্য হয় ব্যবসায়ীরা। হুন্ডি সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজিসহ এসব অতিরিক্ত খরচের টাকা সুদেআসলে পুষিয়ে নিতে তারা বার বার মূল্য বাড়ালেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যেন কিছুই করনীয় নেই। গোশত ব্যবসায়ীরা তাদের চার দফা দাবির মধ্যে জনৈক ব্যক্তির নামোল্লেখ করে তার চাঁদাবাজি ও হুন্ডি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিল বলে জানা যায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভারতীয়দের মত আইন করে গরু জবাই বন্ধ করা না হলেও গরুর গোশত ব্যবসায় চাঁদাবাজি ও হুন্ডি সিন্ডিকেটের যোগসাজশে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল গরুর গোশতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের প্রকারান্তরে গরুর গোশত খাওয়াকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছে। ভারতীয় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিগত দু’টি কোরবানীর ঈদে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করে দেশের কৃষক ও খামারিরা প্রমাণ করেছে, তারা গরুর গোশতের সারা বছরের চাহিদা পূরণেও সক্ষম। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বছরে দেশে গরুর গোশতের ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৯ লাখ টন বা শতকরা ১৪ ভাগ। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা উন্নতজাতের দ্রুত বর্ধনশীল ষাঁড় উৎপাদনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়েক বছরের মধ্যেই এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তার আগে চাঁদাবাজি ও হুন্ডি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে গরুর গোশতের মূল্য কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।