Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

চাপের রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ : ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার মধ্য দিয়ে সে দেশের তো বটেই বিশ্ব রাজনীতিও বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেয়েছে। ইতোমধ্যে তার অস্বাভাবিক ক্রিয়াকর্ম আমরা দেখতে পাচ্ছি। তার ব্যক্তিগত আচার-ব্যবহারও অত্যন্ত রুঢ়। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন অন্য কোনো দেশের সাথে টেলিফোনে কথা বলেন, তখন তাতে উচ্চ কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিচয় থাকে। ট্রাম্প এসব কূটনৈতিক প্রথার ধার ধারেন না। তিনি যখন কথা বলেন, তখন তার কথাবার্তায় এক ধরনের ঝাঁজ বা ঝগড়াটে ভাব ফুটে ওঠে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রথম টেলিফোন কথাবার্তায় যেভাবে তাকে ধমকেছেন, তা এক বিরল ঘটনা। তাকে ধমকেই থামেননি, কোনো ধরনের সৌজন্য না দেখিয়ে ঠাস করে টেলিফোন রেখে দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের আচরনে স্তম্ভিত হওয়ার কথা। এ টেলিফোনিক কথাবার্তা নিশ্চিতভাবেই তার জেন্টলম্যানশিপের সাথে খাপ খায় না। হয়তো কখনো তিনি এসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। হওয়ার কথাও নয়। আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এভাবে তাকে ধমকাবেন, এটা কস্মিনকালেও তার ভাবনায় স্থান পায়নি। কারণ দুই শক্তিধর দেশের সরকার প্রধানদের মধ্যে ভাব গাম্ভীর্য, সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং অত্যন্ত ভদ্র কথাবার্তা হবে, এটাই স্বাভাবিক। ট্রাম্পের আচরণ কি এবং কেমন, তা ইতোমধ্যে তাকে যারা নির্বাচিত করেছে, তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। কয়েক দিন আগে একটি ছোট্ট খবর বের হয়েছে। ট্রাম্পকে ভোট দেয়া নিয়ে আমেরিকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের প্রার্থী হওয়ার সময় থেকে শুরু করে নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত আমেরিকার রাজনীতিতে যেমন বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পরিবার এবং পারস্পরিক বন্ধুত্বেও ভাঙন ধরেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত রয়টার্সের এক জরিপ থেকে জানা যায়, অবসরপ্রাপ্ত এক মহিলা কারা প্রহরী গেইল ম্যাককরমিক জানিয়েছেন, গত বছর বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চ করার সময় তার স্বামী যখন জানান, তিনি ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, তখন বিস্মিত হয়েছিলাম। ৭৩ বছর বয়সী ম্যাককরমিক বলেন, আমি কল্পনাও করিনি আমার স্বামী এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তখন ভাবলাম যে ট্রাম্পের মতো মানুষকে ভোট দিতে পারে, এমন একজন মানুষের সাথে সংসার করব কীভাবে। এই ভেবে তিনি স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান। এখন তিনি আলাদা বসবাস করছেন। ওহাইও অঙ্গরাজ্যের এক ট্রাক চালক ২৫ বছর বয়সী রব ব্রুনেলো জানান, ট্রাম্পকে ভোট দেয়ার কারণে তিনি পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ফিলাডেলফিয়ার ৫৭ বছর বয়সী সুয়ে কোরেন জানান, ট্রাম্পকে সমর্থন করায় তিনি তার দুই ছেলের সঙ্গে খুব কম কথা বলেন। নিউ অরলিয়ন্সের রেডিওর প্রযোজক জর্জ ইংমায়ার জানান, ট্রাম্পকে সমর্থন করায় তিনি তার চাচার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। জরিপে বলা হয়, ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে ১৩ ভাগ নাগরিক পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের অবসান ঘটিয়েছেন। এবারের মার্কিন নির্বাচনে মানুষের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট দলের সমর্থকদের মধ্যে সামাজিক আচরণেও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সরকারের প্রতি অবিশ্বস্ততা রাজনৈতিক সমঝোতার জায়গাটা সংকীর্ণ করে দিচ্ছে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে আরো সংকীর্ণ হবে। এক ট্রাম্পের কারণে কীভাবে তার দেশের মানুষের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক এবং বিভেদ এবং ভৌগোলিক রাজনীতি উলট-পালট হচ্ছে, তা এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এ পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন, তেমনি বিশ্বের জন্যও অত্যন্ত উদ্বেগের। অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্পের উল্টাপাল্টা আচরণের কারণে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও লেগে যায়, তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দুই.
যারা মনে করেন, আমি রাজনীতি করি না, রাজনীতি বুঝি না, এ নিয়ে মাথাঘামাতেও চাই নাÑ তাদের এ কথা মোটেও সঠিক নয়। তিনি চান বা না চান, তিনি যে রাজনীতির বাইরে নন এবং রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যেই বসবাস করেন, এটা নিশ্চিত। এ থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। সবকিছুই রাজনীতির অধীন এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই পরিচালিত হয়। হোক সেটা সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় কিংবা ভাল বা মন্দ। প্রত্যেকের মধ্যেই সদাসর্বদা রাজনৈতিক ধারা প্রবাহমান। কোনোটি দৃশ্যমান, কোনোটি ¯্রােত হারানো নদীর মতো। অনেকে প্রায়ই বলে থাকেন, আমি পেটের রাজনীতি করি। পেট ভরা থাকলে, আর কিছুর দরকার নেই। তারা সরলভাবে কথাটি বললেও, এটিই যে সবচেয়ে বড় রাজনীতি তা বুঝতে চান না। কারণ দুবেলা দুমুঠো পেট ভরে খাওয়া এবং একটু সুখ-স্বচ্ছন্দে বসবাস করা থেকেই মূলত রাজনীতির উদ্ভব। তাদের এ কথার সূত্র ধরেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বড় বড় রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে এবং তার নেতানেত্রীর আবির্ভাব ঘটেছে। দলগুলোর গঠনতন্ত্র এবং নেতানেত্রীদের বক্তব্য-বিবৃতিতেই মানুষের সুখ-দুঃখের কথা থাকে। একেক দল এবং তার নেতানেত্রীরা একেকভাবে কথা বললেও, মূল সুর হচ্ছে, গরীব-দুঃখী এবং সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। পেট ভরে ভাত খাওয়ানোর কথা তাদের মুখ থেকে অহরহ বের হয়। যাদের কথা সাধারণ মানুষের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় এবং তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিতে কিঞ্চিত হলেও ভূমিকা রাখতে পারবে, তাদেরকেই ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় পাঠায়। এই যে ভোট দেয়া, এটাই সবচেয়ে বড় রাজনীতি। এই রাজনীতির প্রভাবের বাইরে কেউই যেতে পারে না। আমরা যে প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে মারামারি, খুনোখুনি, রক্তপাত দেখছি, তা এই পেটের রাজনীতির কারণেই। কে কোন এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি করবে এবং এর মাধ্যমে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করবে, তার মধ্যেই পেটের রাজনীতিটি জড়িয়ে আছে। প্রশাসনিকভাবে যেসব বড় বড় দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ইত্যকার ঘটনা ঘটছে, তার পেছনেও ব্যক্তির সুখের রাজনীতি রয়েছে। পার্থক্য শুধু এটুকুই, পেটের রাজনীতিতে অতি দরিদ্র মানুষটি শুধু পেটের চিন্তাই করেন। আর ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার কাছাকাছি প্রভাবশালী ব্যক্তি তার পেটকে আরও কিভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলতে পারে, এ চিন্তায় থাকেন। এসব কিছুই রাজনীতির মধ্যে থেকেই হচ্ছে। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, রাজনীতিটি সুস্থ নাকি অসুস্থ। সুস্থ হলে তার সুফল প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষটিরও কাছেও পৌঁছায় উপকার হয়। অসুস্থ হলে তার পেটের টান চিরকালই থেকে যায়। পেট আর ভরে না। আমেরিকার রাজনীতিতে বরাবরই একটি সুশীল অবস্থা বজায় থাকে। সেখানের জনগণকে পেটের রাজনীতি নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না। বহমান রাজনীতিই তাদের পেট ভরিয়ে দেয়। এমন এক সুশীল রাজনৈতিক ধারায় এখন ভাঙন ধরেছে। দুই ধারার রাজনৈতিক আদর্শ দীর্ঘকাল পাশাপাশি বহমান থাকলেও তাতে এখন সংঘাত দেখা দিয়েছে। অথচ আমেরিকার রাজনীতি এতদিন শান্ত দীঘির মতোই স্বচ্ছ-টলমল ছিল। এ দীঘিতে ট্রাম্প নামক এক বড় ঢিল পড়ায় তা এখন উত্তাল হয়ে উঠেছে। এমনই উত্তাল যে পারিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্বÑ সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়েছে। সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে কিনা, তা জানা নেই। তবে যা ঘটে তা হচ্ছে প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিপক্ষের মারামারি। যারা ক্ষমতায় থাকে তারা বিরোধী দলকে কোনো রকম ছাড় দিতে রাজি হয় না। মনে করে দেশ তাদের, কাজেই প্রতিপক্ষ যারা আছে, তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। তাদের পিটিয়ে শুইয়ে দিতে পারলে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করা যাবে।
তিন.
আমেরিকার রাজনীতির সাথে আমাদের রাজনীতির পার্থক্য হচ্ছে, আমাদের রাজনীতিতে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের একটা লক্ষ্য থাকে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও চাপে রেখে মারতে মারতে সংকুচিত করে ফেলা। তাদের মানসিকতায় এ ধরনের একটি অপসংস্কৃতি প্রবলভাবে রয়েছে। আমেরিকার রাজনীতিতে এমন অপসংস্কৃতি দেখা যায় না। এই যে ট্রাম্পের মতো একজন উগ্র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তার কর্মকা- যাই হোক, তিনি কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিপক্ষের উপর হামলে পড়েননি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবহার করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্যোগ নেননি। অথচ ক্ষমতায় আসার পর তার যে উলট-পালট করা কর্মকা-, তাতে যদি তার প্রতিপক্ষ দল ডেমোক্রেটদের ধ্বংস করার জন্য বুলডোজার চালিয়ে দিতেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। কংগ্রেসে তার দলের যে নিরঙ্কুশ আধিপত্য রয়েছে, তা দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার উদ্যোগ নিতে পারতেন। ক্ষমতায় এসেই ডেমোক্রেট নেতাদের একের পর এক মামলা দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া থেকে শুরু করে, সমর্থকদের উপর হামলা, হয়রানি, বাড়িতে থাকতে না দেয়া, খুন, গুমের মতো পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন। নিদেন পক্ষে চাপে রাখার অপরাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়তে পারতেন। বিরোধী দলের প্রতি এমন আচরণ করলেও অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকত না। নিপীড়ন জায়েজ করার জন্য টিভি টকশোতে সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের উস্কে দিতে পারতেন। তারা চোশত ভাষায় বিশ্লেষণ করে বলতেন, ক্ষমতায় গেলে বিরোধী দলের উপর অমন একটু আধটু নিপীড়ন হতেই পারে। এটা দোষের কিছু নয়। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই যে হাজার হাজার মানুষ আমেরিকার রাস্তায় নেমে এসেছে এবং ট্রাম্পকে মানি না, মানব না, সে আমাদের প্রেসিডেন্ট নয় ইত্যাদি শ্লোগান দিচ্ছে, তাতে কিন্তু ট্রাম্প কোনো ধরনের বাধা দিচ্ছেন না। অথচ তিনি পারতেন, এসব আন্দোলনরত মানুষকে পিটিয়ে পিঠের চামড়া তুলে রাস্তা থেকে বিদায় করে দিতে। নাশকতা বা ভাঙচুরের অভিযোগে গণহারে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যেতে। তিনি তা করেননি। বরং তার ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর এ আন্দোলন করতে দিচ্ছেন। অথচ এ ধরনের আন্দোলনের ধারা আমাদের দেশের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। চিরকালের এ বৈশিষ্ট্য বিগত কয়েক বছর ধরে স্তব্দ হয়ে আছে। অন্যভাবে বললে স্তব্দ করে দেয়া হয়েছে। এখন রাজনীতিটি হয়ে পড়েছে চাপ এবং নিশ্চিহ্ন করণের। সরকার কোনোভাবেই চায় না, তার প্রধান প্রতিপক্ষ রাজনীতি করুক। বিশেষ করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর সরকারের মধ্যে এ প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার প্রধান প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে না পারলেও একটি প্রান্তিক দলে পরিণত করার প্রক্রিয়া জোরেসোরেই চলছে। আমেরিকার জনগণের মতো রাস্তায় নেমে যে শ্লোগান দেবে, মানি না, মানব নাÑ তার কোনো সুযোগই দেশে এখন নেই। বিরোধী দল রাস্তায় নামতে গেলেই ‘নাশকতা’ করবে বলে ঝেটিয়ে বিদায় করে। এক ধরনের কূটকৌশলের খেলা রাজনীতিতে অব্যাহতভাবে চলিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইদানীং সরকারি দলের নেতারা স্পষ্ট করেই বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিপক্ষ অংশগ্রহণ না করলে আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে। অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি শুরু হবে। অর্থাৎ প্রধান প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রবল একটি চাপ তারা অব্যাহত রেখেছে এবং তারা চাইছেই বিরোধী দল সংকুচিত হয়ে পড়ুক। এ রাজনীতিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির চরম অবক্ষয়। একে রাজনীতি বলতে তারা চান না। বলেন, চরম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। সরকারি দলের এ মনোভাবকে চরম অগণতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিজম বলে আখ্যায়িত করছেন। এই ফ্যাসিজমের কারণে কি হয়? সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। পারস্পরিক দ্বিধা ও ভয় জন্ম নেয়। বহু আদর্শিক রাজনীতিকে রুদ্ধ করে এক আদর্শিক রাজনীতি জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়। এ ধরনের সরকার অন্য আদর্শের রাজনীতির টুটি চেপে ধরে। ভিন্ন মতের মানুষের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে তাদের দমিয়ে রাখে। এখন এমন এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক ধারা চালু রাখা হয়েছে।
চার.
রাজনীতির অস্বাভাবিক পরিবর্তন যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে। ট্রাম্প তো তবু জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। আর জনগণের ভোটে যদি কোনো সরকার নির্বাচিত না হয়, তার প্রতিক্রিয়া কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা অতীতে দেখেছি, এখনো দেখছি। এ ধরনের সরকার প্রতিশোধপরায়ন হয়ে থাকে। প্রতিশোধের রোস্ব গিয়ে পড়ে প্রধান প্রতিপক্ষের উপর। কারণ সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায়, নির্বাচনটি ভোটারবিহীন হয়েছে এবং সরকারের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কাজেই সরকারের সব জেদ প্রধান প্রতিপক্ষের উপর গিয়ে পড়ে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়ায়, আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার খেসারত তোমাকে দিতেই হবে। সরকার তখন জনগণের দিকে না তাকিয়ে প্রশাসনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রশাসনিক সব যন্ত্র ব্যবহার করে একদিকে নিজেকে রক্ষা করে অন্যদিকে বিরোধী দল যাতে রাস্তায় নেমে তাকে আর প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, এ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র সে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে। ২০১৯ সালে যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়েও সরকারের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। কারণ গত নির্বাচনটি ভোটারবিহীনভাবে পার করলেও, আরেকটি এমন নির্বাচন হোক সে তা চাইবে না। এ নির্বাচনে তার প্রধান প্রতিপক্ষ অংশগ্রহণ করবে। এই অংশগ্রহণই তার ভয়ের কারণ। একদিকে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে না দেয়া অন্যদিকে ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা। এ দুয়ে মিলে সরকার এখন বেশ চাপে আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিষয়টি সরকার যেমন বোঝে, তেমনি সচেতন মানুষও বোঝে। ফলে সরকার মুখে মুখে তার প্রধান প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব সংকোচনের কথা বলে নিজে সাহস সঞ্চার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর যত ধরনের কূটকৌশল আছে, তার সবই অবলম্বন করে চলেছে। এটা রাজনৈতিক নৈরাজ্য ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ স্বাভাবিক রাজনীতিতে এমন হওয়ার কথা নয়। রাজনীতিতে কৌশল থাকবে, তবে তা হবে সুস্থ, যা গণতন্ত্রের পরিধির মধ্যে চর্চিত হবে। এই যে রাজনৈতিক শত্রুতা তা কোনোভাবেই দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য সহায়ক নয়। কারণ উন্নয়ন-অগ্রগতি সাধিত হয় সুষ্ঠু রাজনৈতিক আবহের মধ্যে থেকে। তাপ ও চাপের রাজনীতির মাধ্যমে সাময়িকভাবে ক্ষমতাসীনরা হয়তো নিজেদের প্রতাপশালী ভাবতে পারে, তবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির ক্ষেত্রে এই তাপ ও চাপ তাদেরই বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ বোঝা বহন করা তখন বেশ দুষ্করই হবে। আমরা মনে করি, যদি রাজনীতিকেই অবলম্বন করতে হয়, তবে তা স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা উচিত। অস্বাভাবিক পন্থায় বা রাজনীতিকে কলুষিত ও কঠিন করার অর্থই হচ্ছে, নিজেকে খেসারতের দিকে ঠেলে দেয়া। কারণ অপরাজনীতির খেসারত সাধারণ মানুষকে দিতে হয় এবং হচ্ছে। এই রাজনীতির সাথে যে দলÑ সে ক্ষমতাসীন হোক বা বিরোধী দল হোক, টুডে অর টুমরো,  তাদেরকেও এর মাসুল গুনতে হবে। আমরা আশা করব, চাপ ও তাপ এবং পরস্পর বিদ্বেষী নেগেটিভ রাজনীতি থেকে ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল বের হয়ে সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসবে যে রাজনীতিতে সমাজ যুথবদ্ধ থাকবে, পারিবারিক বন্ধন অটুট থাকবে, বন্ধুত্ব সুদৃঢ় হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ