Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে মৃত্যুর মিছিল কি দীর্ঘ হতেই থাকবে?

| প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এ মিছিল অপ্রতিরোধ্য। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। গত শুক্রবার ফরিদপুরের নগরকান্দায় এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়, আহত হয় ৩৩ জন। একটি যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে গ্যাস সিলিন্ডার ভর্তি কাভার্ড ভ্যানের সংঘর্ষে এই মর্মবিদারি হতাহতের ঘটনা ঘটে। শনিবার রাত পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় আরও ১২ জন নিহত ও ৪২ জন আহত হয়। রবিবার নরসিংদীতে বাস ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় ৩০ জন। একই দিনে রাজধানী ও সাভারে পৃথক দুর্ঘটনায় আরো অন্তত ২ জনের মুত্যু হয়। মাত্র তিনদিনে মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯। আহতের সংখ্যা শতাধিক। এই হিসাব মতে, তিনদিনে গড়ে প্রতিদিন ১৩ জন নিহত ও ৩৩ জনের বেশি আহত হয়েছে। বেপরোয়া গাড়ি চালানোই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত। আলোচ্য দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও সেটা লক্ষ্য করা গেছে। চালকদের বড় অংশই যে অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত, লাইসেন্সবিহীন, প্রতিযোগিতাপ্রবণ এবং ট্রাফিক আইন বেতোয়াক্কাকারী, সেটা বার বার পর্যবেক্ষণ, সমীক্ষা ও গবেষণায় উঠে এসেছে। এরপরও এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও তাতে হতাহতের ঘটনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশের হিসাবে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে এ সংখ্যা ৬ থেকে ৭ হাজার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে ১২ হাজার থেকে ১৪ হাজার। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দাবি, ২০ হাজারেরও বেশি। হিসাবগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকলেও পুলিশের হিসাবের চেয়ে মৃত্যুর সংখ্যা যে অনেক বেশি তাতে সন্দেহ নেই। যাত্রীকল্যাণ সমিতি সাধারণত, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে হতাহতের হিসাব তৈরি করে। সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের অনেক খবরই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। এই যে ২-৩ হাজার থেকে ২০ হাজারের মতো মানুষ মারা যায়, একে কি আমরা আদৌ গুরুত্ব দিই? শত শত মানুষ যে প্রতি বছর, আহত কিংবা পঙ্গু হয়ে অক্ষম হয়ে যায়, তাদের কথা কি বিবেচনায় নেই?
অবস্থাদৃষ্টে সেটা মনে হয় না। আদৌ যদি হতাহতের সংখ্যা এবং পরিবার ও সমাজে এর প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিতাম, বিবেচনায় নিতাম তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার সয়লাব ও হতাহতের ‘মড়ক’ ঠেকানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতাম এবং অবশ্যই এতদিনে তা সহনসীমার মধ্যে চলে আসত। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা তো কমছেই না, আরও বাড়ছে। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, এই অপ্রতিরোধ্য ও প্রতিকারহীন সড়ক দুর্ঘটনা, এই অসহায় মৃত্যু ও আহতদের জীবন-মৃত অবস্থায় বেঁচে থাকার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী কে বা কারা? ট্রাফিক পুলিশ, বিআরটিএ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এ দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। তাদের অবহেলা, অমনোযোগ ও দায়িত্বহীনতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা গুরুতর জাতীয় সমস্যা ও নাগরিক উদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন সমীক্ষা-গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের গাড়ি চালকদের বেশিরভাগ অদক্ষ ও অপ্রশিক্ষিত, অনেকের লাইসেন্স নেই, অনেকের লাইসেন্স ভুয়া। এদের হাতে গাড়ি ছেড়ে দেয়া বিপজ্জনক। অথচ মালিকদের একাংশ সেটাই করছে। লাইসেন্স দেয়ার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সেখান টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া লাইসেন্স দেয়া হয়। গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেটের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই চলছে অগুনতি গাড়ি। সড়কে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ। সেখানেও রয়েছে দুঃখজনক গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতা। সড়কে চলছে হত্যার প্রতিযোগিতা।
তাহলে কি এই অনিয়ম, দুর্বৃত্তাচার, যথেচ্ছার, মৃত্যুর প্রতিযোগিতা চলতেই থাকবে? সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো অনেক আগেই শনাক্তকৃত। কী করলে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব, তাও বিশেষজ্ঞরা বহুবার বলেছেন। তারপরও কিছু হচ্ছে না। আমরা বিশ্বাস করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো সচেতন, তাৎপর ও দায়িত্বশীল হলে সড়ক দুর্ঘটনার অভিশাপ থেকে দেশকে একেবারে মুক্ত করা সম্ভব না হলেও দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কমিয়ে আনা অবশ্যই সম্ভব। স্বীকার না করে উপায় নেই, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট বলতে যা বুঝায়, গোটা দেশেই তো ভেঙে পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশের একটি বড় অংশ দায়িত্বপালনের চেয়ে চাঁদাবাজিতে অধিকতর তৎপর। তারা শক্ত হলে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ট্রাফিক বিধি লংঘন করা চালকদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না। আরো একটা বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সেটা হলো, সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনার তদন্ত ঠিকমত হয় না। বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও আছে। অধিকাংশ সময় ঘাতক চালক আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে বেরিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচার হলেও সাজা হয় নামকাওয়াস্তে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দায়ীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার দাবি বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা যে কমে আসতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য, এ অবস্থা চলতে পারে না। যে কোনো মূল্যে সড়কে মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলো যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন