চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আতিকুর রহমান নগরী : মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে হেকমত অবলম্বন করে ওয়ায-নসিহতের মাধ্যমে খোদার রাহে, হেদায়াতের পথে আহ্বান করার কথা স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন। এ ব্যাপারে সূরা নাহলের ১২৫নং আয়াতে বর্ণিত আছে ‘আপনি হেকমত ও উত্তম কথামালার দ্বারা মানুষদেরকে প্রতিপালকের রাহে আহ্বান করুন।’ নবী-রাসূলরা আর আসবেন না উম্মাহকে এ পথে আহ্বান করার জন্য। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)’র মাধ্যমে নবী আগমনের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ কাজের যিম্মাদারী কোরআনের ভাষ্যানুযায়ী আমাদের উপর বর্তায়। কেননা বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারীমে ‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন’ আয়াতাংশে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মাহ বা জাতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের পিছনে রয়েছে ‘আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করা। দাওয়াতে তাবলীগ যা প্রত্যেক নবী-রাসূলের আগমনের মূল লক্ষ্য। একমাত্র এর দ্বারাই পারি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে।
বিশ্বখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপিঠ দারুল উলুম দেওবন্দের সূর্য সন্তান আল্লামা শাহ ইলিয়াস (রাহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘তাবলীগ জামাতের’ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে কীভাবে প্রিয়নবী (সা.)’র প্রতিটি উম্মতকে আল্লাহওয়ালা বানানো যায়। কীভাবে মুসলিম জাতিকে তাকওয়া ওয়ালা বানানো যায়, নামাজি বানানো যায় ইত্যাদি। তাই বছরে একবার সম্মিলিতভাবে বিশ্বের সব মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে ঈমানী মুযাকারা করার মানসে তুরাগপাড়ে বসে ‘বিশ্ব মুসলিমদের’ মিলনমেলা। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক সারাবিশ্বে হেদায়াতের হাওয়া।
বিশ্ব ইজতেমা সাধারণত বৈশ্বিক যেকোনো বড় সমাবেশ, কিন্তু বিশেষভাবে তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ, যা বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাবলিগ জামাতের এই সমাবেশটি বিশ্বে সর্ববৃহৎ এবং এতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ‘বিশ্ব ইজতেমা’ শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের মিশ্রনে সৃষ্ট। আরবি ‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ সম্মিলন, সভা বা সমাবেশ। সাধারণত প্রতি বছর শীতকালে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়ে থাকে, এজন্য ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসকে বেছে নেয়া হয়।
১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রতি বছর এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজি ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল।
প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা অংশ নেয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান অবধি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদের উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমে প্রাপ্ত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লক্ষাধিক মুসল্লি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.) ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামী দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। পুরো সমাবেশের আয়োজনই করে থাকেন একঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ। যারা আর্থিক, শারীরিক সহায়তা দিয়ে প্রথম থেকে আখেরতক এই সমাবেশকে সফল করতে সচেষ্ট থাকেন।
পুরো সমাবেশ স্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ, যা বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শুধুমাত্র বিদেশি মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেঙার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশ স্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীগণ খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান শনাক্ত করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাওয়ারি মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। বিদেশি মেহমানদের জন্য আলাদা নিরাপত্তা বেষ্টনী সমৃদ্ধ এলাকা থাকে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকরাই কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, কোনো সশস্ত্র বাহিনীর অনুপ্রবেশের অধিকার দেয়া হয় না।
সাধারণত তাবলিগ জামাতের অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্ন তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্ছা পোষণ করেন। সে হিসাবেই প্রতি বছরই বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিনদিনজুড়ে। সাধারণত প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আমবয়ান ও বাদজুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এ বছর ৮ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হয়। প্রতি বছরই এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিশ্ব ইজতেমা প্রতি বছর দু’বারে করার সিদ্ধান্ত নেয় কাকরাইল মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং তিনদিন করে আলাদা সময়ে মোট ছয়দিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ আম বয়ান বা উন্মুক্ত বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয় এবং আখেরি মোনাজাত বা সমাপনী দোয়ার মাধ্যমে শেষ হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।