Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মাদকের ছোবল থেকে কিশোর-তরুণদের বাঁচাতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রায় প্রতিদিনের সংবাদপত্রে একটি খবর চোখে পড়ছে। বলা যায়, এটি কমন সংবাদ। সরকারের মন্ত্রী, আমলা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি- সবাই একযোগে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের এ বক্তব্য ও আহ্বান সংবাদপত্রগুলোতে গুরুত্ব সহকারে ছাপা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের হুমকির বাইরে নেই আমাদের দেশও। বিশ্বের তাবৎ দেশ জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের হুমকির মধ্যে আছে। আমাদের দেশে ইতোপূর্বে বেশকিছু জঙ্গি বা সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এতে অনেকে নিহত ও আহত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কথা বলা, তা মোকাবিলায় আহ্বান জানানো কিংবা অভিযান, ধর-পাকড় চালানো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের জন্য এর চেয়েও বড় হুমকি যে মাদক, তা নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা শোনা যায় না, তার মোকাবিলায় এগিয়ে আসার সে রকম জোরালো আহ্বান জানানো হয় না, অভিযান-আটক তো হয় না বললেই চলে। কেন এই অমনোযোগ-অবহেলা-এর কোনো সদুত্তর নেই। আইন-শৃংখলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রায়ই এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করেন যে, জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসীদের নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বহু জঙ্গি-সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়েছে, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে অভিযান অব্যাহত আছে এবং এর উৎসাদন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাদের এসব কথাবার্তায় আমরা আশ্বস্ত বোধ করতে পারি। তবে আমরা যারপরনাই বিচলিত ও উদ্বিগ্ন মাদকের আগ্রাসন ও বিস্তার নিয়ে। কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জঙ্গিবাদের চেয়ে মাদক আরো ভয়ংকর। তার এ কথার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই।
জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তি বা পরিবার। সমাজে ভীতি-শংকাও বাড়ে। কিন্তু মাদক ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে রীতিমত বিপর্যস্ত ও ধ্বংস করে দিচ্ছে। মাদকের আগ্রাসন ও বিস্তার সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করছে। সমাজের এমন কোনো শ্রেণী বা স্তর নেই যেখানে মাদক ঘাঁটি গেড়ে না বসেছে। রাজধানী শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র মাদকের ছড়াছড়ি। কর্ম, পেশা, বয়স নির্বিশেষে মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে কিশোর-তরুণরা অধিক সংখ্যায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। শহুরে বিত্তবানের ইংরেজি মাধ্যমে পড়–য়া সন্তান থেকে গ্রামের দীন-দরিদ্রের সন্তান পর্যন্ত মাদকাসক্তিতে আক্রান্ত। কে না জানে, শিশু-কিশোর-তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ। একদিন তারাই দেশ-জাতির নেতৃত্ব দেবে। আজ মাদক-আগ্রাসনে তারাই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে মর্মান্তিক, বেদনায়ক ও উদ্বেগজনক আর কিছু হতে পারে না। মাদকের কারণে সমাজে খুন, ধর্ষণ, অনিরাপত্তা, বিশৃংখলা ও নানাবিধ অপরাধের বিস্তার ঘটছে। মাদকের কারণে খুনোখুনি, পারিবারিক অশান্তি, বিচ্ছেদ-বিপর্যয় যে কত ঘটছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাদকের জন্য অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে মাদকাসক্তরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যে করছে না। এক খবরে জানা গেছে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। এর মধ্যে সিংহভাগই শিক্ষার্থী। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দেয়া এ তথ্য থেকে বুঝা যায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কতটা বিপর্যয়কর ও নাজুক হয়ে পড়েছে। অনেকের ধারণা, মাদকাসক্তদের সংখ্যা বিশেষত, শিক্ষার্থীদের সংখ্যা আরো বেশী হবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের অধস্তন প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
মাদকের সহজলভ্যতা মাদকাসক্তদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ। রাজধানী থেকে গ্রাম, যেখানেই হাত বাড়ানো যায়, সেখানেই কোনো না কোনো মাদক পাওয়া যায়। সীমান্তের ওপর থেকে ইয়াবা-ফেন্সিডিলসহ বিভিন্ন মাদক সামগ্রী বানের পানির মতো দেশে ঢুকছে। সুনিয়ন্ত্রিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারী চক্র ও তাদের এদেশীয় এজেন্টরা সবকিছু ম্যানেজ করে মাদক সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে আসক্তদের হাতে। আমরা এর আগেও বিভিন্ন উপলক্ষে বলেছি এবং এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, মাদকের অনুপ্রবেশ ও চলাচল রোধ করা ছাড়া এর দৌরাত্ম্য ও আগ্রাসন থেকে মুক্তি লাভের সহজ কোনো পথ নেই। মাদকের দরজা খোলা রেখে যদি বলা হয়, কেউ মাদক সেবন করবে না, সেটা কোনো কাজে আসবে না। অতএব, মাদক চোরাচালান ডেড স্টপ করতে হবে, চোরাচালানী চক্রের নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে হবে এবং মূল হোতাদের গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ দায়িত্ব নিতে হবে বিজিবি ও আইন-শৃংখলা বাহিনীকে। সীমান্ত পথে মাদক আসতে না পারলে এবং দেশের অভ্যন্তরে মাদকের চলাচল রহিত করা সম্ভব হলে তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া অবশ্যই পাওয়া যাবে। আর মাদকের বিরুদ্ধে, মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে লাগাতার অভিযান চালানো গেলে মাদক নির্মূল সহজ হয়ে যাবে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার দৈন্য উদ্বেগজনক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। অধিকাংশ কিশোর ও তরুণ মাদক সেবনে কোনো নৈতিক ও আত্মিক বাধা অনুভব করে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় ও পরিবারে নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। কাজেই, মাদকাসক্তকে সুবচন শোনালে, গ্রেফতার কিংবা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করলেই এ সমস্যার সমাধান হবে না। নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি মাদকবিরোধী প্রচারণা, মাদকের বহুমুখী প্রতিক্রিয়া ও ক্ষতি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই জাতির ভবিষ্যৎ হিসাবে গণিত কিশোর-তরুণদের সুরক্ষা করতে হবে। যে কোনো কাজের চেয়ে এ কাজটি বড়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন