Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা ইস্যুতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মিয়ানমারের সরকারী বাহিনী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধদের সহিংসতা ও নির্মম দমনাভিযান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা নিরসনে কোফি আনান কমিশনের সদস্যরা কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে প্রকাশিত এক মূল্যায়ন রিপোর্টে তারা ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের হাতে’ বলে মত দিয়েছেন। এই সমস্যা মিয়ানমার সরকারের সৃষ্টি এবং এর সমাধানও তাদেরই হাতে, এটা এক গৎবাঁধা মন্তব্য, একজন অতি সাধারণ মানুষও তা বোঝে। মিয়ানমার সরকার প্রতিবেশী বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান ও অনুরোধ উপেক্ষা করেই সেখানে জাতিগত গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। এই সমস্যা সমাধানে তাদের কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যথেষ্ট চাপ দেয়া হলে তারা নমনীয় হতে বাধ্য। সাম্প্রতিক সময়ে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ উদ্যোগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসি’র পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মত আসিয়ানভুক্ত ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো শক্ত অবস্থান নিলে তা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মিয়ানমারের নেই। রোহিঙ্গা গণহত্যা এখন একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানবতার সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে সম্প্রতি কিছু সময় চেয়েছে মিয়ানমার সরকার। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বলছে রাখাইনে চলমান রোহিঙ্গা নির্মূল অভিযানকে প্রলম্বিত করে আরো মানুষ হত্যা করাই তাদের সময় ক্ষেপণের মূল উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে সেখানে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ও উচ্ছেদ করার পর কিছু খালি জায়গা ডেভেলপার কোম্পানীকে লীজ দেয়া হয়েছে বলেও খবর বেরিয়েছে।   
গত কয়েক বছরের আন্তর্জাতিক জরিপে রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায়কে বিশ্বের সবচে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করলেও বৃটিশ ঔপনিবেশোত্তর বার্মায় সামরিক জান্তা সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের সমর্থন পেতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের প্রশ্নে ইচ্ছাকৃত জটিলতা তৈরী করেছে। মিয়ানমারে শতাধিক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করলেও অসৎ উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তালিকার বাইরে রাখা হয়। মিয়ানমারের নাগরিকদের নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে নানা শ্রেণী বিভাজন রয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের কোন তালিকায়ই স্থান না দিয়ে তাদেরকে নির্মূল এবং বিতাড়নের পন্থা বেছে নেয় সেখানকার সামরিক সরকার। অং সান সুচির নেতৃত্বে দীর্ঘ  আন্দোলন-সংগ্রামের পর মিয়ানমারে নির্বাচিত সরকার ফিরে আসার পর রোহিঙ্গাদের অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের বদলে মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। পাঁচ দশকের বেশী সময় ধরে অধিকার বঞ্চিত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নতুন গণতান্ত্রিক শাসনামলে সবচে বড় গণহত্যা বা এথনিক ক্লিনজিংয়ের শিকার হচ্ছে। উগ্র বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং সরকারী বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন থেকে বাঁচতে সীমান্ত পেরিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও এসব শরণার্থীর মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়া এবং তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও মানবাধিকার সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তেমন কোন উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। তবে  মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া ব্লুম বার্নিকাট রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হবে বলে জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি দেশে অনেক আভ্যন্তরীণ ইস্যুতেও মার্কিনী ও পশ্চিমারা নাক গলিয়ে হস্তক্ষেপ করলেও হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান হত্যা এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মানবিক অধিকার রক্ষায় তাদের নীরবতা ছিল বিস্ময়কর। অনেক দেরিতে হলেও তাদের এই বোধোদয় পরিস্থিতি উন্নয়নে ইতিবাচক ফল দেবে বলে আমরা আশাবাদী।
একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে অং সান সুচির দল ক্ষমতালাভের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বের ইস্যুটির সমাধান হবে বলে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ছিল। বিশেষত, নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত গণতন্ত্রপন্থী নেতা অং সান সুচির কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশী। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সুচির শাসনামলেই রাখাইন মুসলমানরা নব্বইয়ের দশকের পর সবচে বড় দমনাভিযানের শিকার হচ্ছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার থেকে প্রায় ৬৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশী হতে পারে বলে জানা যায়। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার অনেক সম্ভাবনাময় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বও অনেক বেশী। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট থেকে সৃষ্টি হলেও তা’ এখন একটি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে আনান কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও আইনগত অধিকার নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা বহনে বাধ্য নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিশেষত, উন্নয়নকামী ও বিনিয়োগ প্রত্যাশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করতে হলে রোহিঙ্গা ইস্যুর গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধান হওয়া জরুরী। এ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এবং চীনের প্রভাব কাজে লাগাতে হবে।



 

Show all comments
  • ইমাদুল হক ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:৪২ এএম says : 0
    তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ব ঘটলে তার জন্য দায়ী কারনগুলোর মধ্যে একটি হবে রহিঙ্গা হস্যু।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন