চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আলতাফ হোসেন খান
॥ দুই ॥
ভ্যালেন্টাইনের সাথে সম্রাটের মেয়ের সম্পর্ক এবং ভ্যালেন্টাইনের প্রতি দেশের যুবক-যুবতীদের ভালোবাসার কথা সম্রাটের কানে যায়। এতে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন। তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি।
তৃতীয় বর্ণনা : সমস্ত ইউরোপে যখন খ্রিস্টান ধর্র্মের জয়-জয়কার তখনও বড় আয়োজন করে পালিত হত রোমীয় একটি রীতি। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের সকল যুবকেরা সমস্ত মেয়েদের নাম চিরকুট তুলত, যার হাত যে মেয়ের নাম উঠত, সে পূর্ণবৎসর ঐ মেয়ের প্রেমে মগ্ন থাকত। আর তাকে চিঠি লিখতে এ বলে যে, ‘প্রতিমা মাতার নামে তোমায় প্রেরণ করছি’। বৎসর সমাপান্তে এ সম্পর্ক নবায়ন বা পরিবর্তন করা হত। এ রীতিটি কতক পার্দীর গোচরীভূত হলে তারা একে সমূলে উৎপাটন করা অসম্ভব ভেবে শুধু নাম পাল্টে দিয়ে একে খ্রিস্টান ধর্মায়ন করে দেয় এবং ঘোষণা করে এখন থেকে এ পত্রগুলো ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’র নামে প্রেরণ করতে হবে। কারণ এটা খ্রিস্টান নির্দশন, যাতে কালক্রমে এটা খ্রিস্টান ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
চতুর্থ বর্ণনা : প্রাচীন রোমে দেবতাদের রাণী জুনো (ঔঁহহড়)’র সম্মানে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছুটি পালন করা হত। রোমানরা বিশ্বাস করত যে, জুনোর ইশার-ইঙ্গিত ছাড়া কোন বিয়ে সফল হয় না। ছুটির পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি লুপারকালিয়া ভোজ উৎসবে হাজারো তরুণের মেলায় র্যাফেল ড্র’র মাধ্যমে সঙ্গী বাছাই পক্রিয়া চলত। এ উৎসবে উপস্থিত তরুণীরা তাদের নামাঙ্কিত কাগজের সিপ জনসম্মুখে রাখা একটি বড় পাত্রে ফেলত। সেখান থেকে যুবকের তোলা সিপের তরুণীকে কাছে ডেকে নিত। কখনও এ জুটি সারা বছরের জন্য স্থায়ী হত এবং ভালোবাসার সিঁড়ি বেয়ে বিয়েতে পরিণতি ঘটত।
পঞ্চম বর্ণনা : রোমানদের বিশ্বাসে ব্যবসা, সাহিত্য, পরিকল্পনা ও দস্যুদের প্রভু ‘আতারিত এবং রোমানদের সবচেয়ে বড় পভু ‘জুয়াইবেতার’ সম্পর্কে ভ্যালেনটাইনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। সে উত্তরে বলে, এগুলো সব মানব রচিত প্রভু, প্রকৃত প্রভু হচ্ছে ‘ঈসা মসীহ’। এ কারণে তাকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে হত্যা করা হয়।
ষষ্ঠ বর্ণনা : কথিত আছে, খ্রিস্টধর্মের প্রথম দিকে রোমের কোন এক গীর্জার ভ্যালেন্টাইন নামক দু’জন সেন্ট (পাদ্রী)-এর মস্তক কর্তন করা হয় নৈতিক চরিত্র বিনষ্টের অপরাধে। তাদের মস্তক কর্তনের তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। ভক্তেরা তাদের ‘শহীদ’(!) আখ্যা দেয়। রোমান ইতিহাসে শহীদের তালিকায় এ দু’জন সেন্টের নাম রয়েছে। একজনকে রোমে এবং অন্যজনকে রোম থেকে ৬০ মাইল (প্রায় ৯৭ কি. মি) দুরবর্তী ইন্টরামনায় (বর্তমান নাম ঞবৎহর) ‘শহীদ’ করা হয়। ইতিহাসবিদ কর্তৃক এ ঘটানা স্বীকৃত না হলেও দাবি করা হয় যে ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্লাইডিয়াস দ্যা গথ’র আমলে নির্যাতনে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমে তাদের সম্মানে এক রাজপ্রসাদ (ইধংরষষরপধ) নির্মাণ করা হয়। ভূর্গভস্থ সমাধিতে একজনের মৃতদেহ আছে বলে অনেকের ধারণা।
সপ্তম বর্ণনা : ৮২৭ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ব্যক্তি রোমের পোপ নির্বাচিত হয়েছিল। তিনি তার চারিত্র্যিক মাধুর্য এবং সুন্দর ব্যবহার দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই রোমবাসীর মন জয় করে নিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৪০ দিন দায়িত্ব পালনের পরই তার জীবনাবসান ঘটে। প্রিয় পোপের মৃত্যুর পর তার স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারি রোমবাসী এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনেকের মতে এভাবেই ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সূচনা হয় ।
এ দিবসে যা করা হয় : পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মধ্যে এ দিনে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও উপহার বিনিময় হয়। উপহার সামগ্রীর মধ্যে আছে পত্র বিনিময়, খাদ্যদ্রব্য, ফুল, বই, ছবি ঠধষবহঃরহব’(আমার ভ্যালেন্টাইন হও), প্রেমের কবিতা, গান কার্ড প্রভৃতি। গ্রীটিং কার্ডে, উৎসব স্থলে অথবা অন্য স্থানে প্রেমদেব (ঈঁঢ়রফ)-এর ছবি বা মূর্তি স্থাপিত হয়। সেটা হল একটি ডানাওয়ালা শিশু, তার হাতে ধনুক এবং সে প্রেমিকার হৃদয়ের প্রতি তীর নিশান লাগিয়ে আছে। এ দিন স্কুলের ছাত্ররা তাদের ক্লাসরুম সাজায় এবং অনুষ্ঠান করে। ১৮শ’ শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে ছাপানো কার্ড প্রেরণ। এসব কার্ডে ভালো-মন্দ কথা, ভয়-ভীতি আর হতাশার কথাও থাকত।
১৮শ’ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যেসব কার্ড ভ্যালেন্টাইন ডে’তে বিনিময় হত তাতে অপমানজনক কবিতাও থাকত। তবে সবচেয়ে যে জঘন্য কাজ এ দিনে করা হয়, তা হল ১৪ ফেব্রুয়ারিতে মিলনাকাক্সক্ষী অসংখ্য যুগল সবচেয়ে বেশি সময় চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া। আবার কোথাও কোথাও চুম্বনাবদ্ধ হয়ে ৫ মিনিটি বা তার বেশি সময় অতিবাহিত করে ঐ দিনের অন্যান্য প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে।
বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে : এ দিবসে ভালোবাসায় মাতোয়ারা থাকে রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো। পার্ক, রোস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, ঢাবির চারুকলার বকুলতলা, আশুলিয়া, কুয়াকাটা এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতসহ-সর্বত্র থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমুল ভিড়। ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে অনেক দম্পতিও উপস্থিত হয় প্রেমকুঞ্জগুলোতে। আমাদের দেশের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী এমনকি বুড়া-বুড়িরা পর্যন্ত নাচতে শুরু করে! তারা পাঁচতারা হোটেলে, পার্কে, উদ্যানে, লেকপাড়ে এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসে ভালোবাসা বিলোতে, অথচ তাদের নিজেদের ঘর-সংসারে ভালোবাসা নেই! আমাদের বাংলাদেশী ভ্যালেন্টাইনরা যাদের অনুরণে এ দিবস পালন করে, তাদের ভালোবাসা জীবন-জ্বালা আর জীবন জটিলতার নাম; মা-বাবা, ভাই-বোন হারানোর নাম, নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত হওয়ার নাম। তাদের ভালোবাসার ‘ধর ছাড়’ আর ‘ছাড় ধর’ নতুন নতুন সঙ্গী। তাদের ধরা-ছড়ার বেল্লেন্ডাপনা চলতে থাকে জীবনব্যাপী।
কোরআন ও হাদীসের আলোকে ভালোবাসা দিবস : ইসলাম কোন গতানুগতিক ধর্মব্যবস্থার নাম নয় বরং এটা পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। মানুষের সৃষ্টি হতে ধ্বংস (মৃত্যু) পর্যন্ত যত পালনীয় এবং বর্জণীয় কার্যাবলী আছে তার সবগুলোই ইসলামে পরিপূর্ণভাবে বর্ণিত আছে। ইসলাম কোন নির্দিষ্ট দিবস পালনের অনুমোদন করে না। অথচ পাশ্চাত্য অপসংস্কৃতি ঢালাওভাবে গ্রহণ করতে গিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং সভ্যতা ভুলে বসে আছি। হাদীস শরীফে এসেছে, ‘রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিধর্মীদের অনুসারী হবে তার হাশর বিধর্মীদের সাথে হবে’। (আবু দাউদ) উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় ভালোবাসা দিবস মুসলিমদের রীতি নয়। এটা খ্রিস্টানদের রীতি। যে রীতি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস এবং তার প্রেমিকার আত্মহত্যা দ্বারা সূচিত হয়েছিল। সুতরাং যদি কোন মুসলিম এই দিবস পালন করে তার হাশর তথা শেষ বিচার ঐ বিধর্মীদের সাথে হবে। ভালোবাসা দিবসের নাম করে বর্তমানে একশ্রেণীর ছেলে-মেয়েরা লোক চক্ষুর আড়ালে নির্জনে সাক্ষাত করে। তারা নানা প্রকার অশ্লীল কর্মকা-ে লিপ্ত থাকে। বিয়ের আগে যে প্রেম ভালোবাসা করা হয় তা অবৈধ। বিয়ের পূর্বে একটা ছেলে একটা মেয়ের সাথে সাক্ষাতও করতে পারবে না। হাদীস শরীফে আছে, ‘হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন, তোমদের কেউ কোন মেয়ের সাথে নির্জনে মিশবে না। তবে তার সাথে কোন পুরুষ থাকলে ভিন্ন কথা’। (বুখারী ও মুসলিম)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।