Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শিল্পে নানামুখী সংকট

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নির্ভর করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকের উপর। কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধি বেশ পুষ্ট দেখানো হলেও বাস্তব পরিস্থিতি তা খুব একটা সমর্থন করছে না। অর্থনীতিতে নানা সমস্যা বিরাজ করছে যা এর গতি শ্লথ করে দিচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, এনবিআরের পক্ষ থেকে সংস্থাটির অঙ্গ অফিসগুলোকে মোটা অঙ্কের টার্গেট ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে অধিকাংশ সংস্থাকে। অন্তত ২০টি সরকারি সংস্থার লোকজন প্রতিনিয়ত চড়াও হচ্ছে উদ্যোক্তাদের উপর। তাদের আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পবিরোধী। এমতাবস্থায়, নতুন শিল্প-কারখানা করা তো দূরের কথা, বিদ্যমান কারখানাগুলো টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রফতানিকারকদের ৪২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সালাম মুশের্দী একটি দৈনিককে বলেছেন, গত দুইবছরে শ্রমিক মজুরি বেড়েছে ৩২ শতাংশ। গ্যাসের খরচ বেড়েছে ১০ শতাংশ। এসময়ের মধ্যে ৩০ শতাংশ বেড়েছে পরিবহন ব্যয়। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অন্য দেশগুলো তাদের উদ্যোক্তাদের নানামুখী প্রণোদনা দিলেও আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের এক বিশেষ সংখ্যায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৪৭ শতাংশ ডিগ্রিধারী লোক বেকার। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর তথ্য মতে, দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে।
দেশের শিল্প যে সংকটাবর্তে হাবুডুবু খাচ্ছে তা নতুন কথা নয়। এখন পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে ধাবিত। এ পরিস্থিতি আরো নাজুক যে হতে পারে সেকথাও প্রকারান্তরে বিশ্বব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই বলে আসছে। তারা একদিকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলার উপর যেমনি গুরুত্ব দিচ্ছে তেমনি বিনিয়োগের জন্য একটি আস্থাশীল পরিবেশ তৈরির উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশ একটি আমদানি নির্ভর দেশ। রফতানির উপর গুরুত্ব দিতে না পারলে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা কঠিন। রফতানি বাড়ানো বা আমদানি কমাতে হলে শিল্পনির্ভরতার কোন বিকল্প নেই। দেশের রফতানির প্রধান উৎস গার্মেন্টস শিল্প নানামুখী জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএফপি সুবিধা না থাকার জের টানতে হচ্ছে। এরপর যদি যেখানে করারোপের প্রসঙ্গ আসে এবং তা যদি ইউরোপীয় বাজারকে প্রভাবিত করে তাহলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবেই। দেশীয় ক্ষেত্রে তেলের দামের সমন্বয়ের কথা বারবার বলা হলেও তা নাকচ করে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির দাম বাড়ছে হুহু করে। কার্যত বর্ধিত বিল-কর পরিশোধের জন্য যে বাজার থাকা দরকার তা বাড়ছে না। অন্যদিকে দেশের শিক্ষিত এবং কর্মোপযোগী যুবকের সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে। এরাও প্রয়োজনীয় কাজ পাচ্ছে না। দেশে শিল্প না বাড়লে কাজের সুযোগ বৃদ্ধির কোন অবকাশ নেই। উদ্যোক্তাদের পক্ষে ব্যাংক লোন নিয়ে বিনিয়োগ করে তা থেকে মুনাফা অর্জন কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের পুঁজিবাজার এখনো এমন সক্ষমতার উপর দাঁড়িয়ে নেই যেখান থেকে টাকা সংগ্রহ করে বিনিয়োগ করা যাবে। বিদ্যমান বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীদের দুর্গতির যে চিত্র দৃশ্যমান তা প্রকৃতপ্রস্তাবে দেশের অর্থনীতির গভীর সংকটের কথাই জানান দেয়। আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ এবং বাংলাদেশের ভাল যারা চায় তার ও বারবার এই বলে সতর্ক করছেন যে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ অন্যত্র চলে যাবে। ইতোপূর্বে প্রকাশিত খবরেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশী অনেক বিনিয়োগকারী তাদের পুঁজি অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাচ্ছেন। সবমিলে কথা হচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য কথা নয়, কাজ প্রয়োজন। প্রকাশিত রিপোর্টেও এটা পরিষ্কার যে, সরকারি নীতি অনুযায়ী শিল্পের বিকাশ ইতিবাচক নয়। শিল্পবান্ধবতার বিবেচনা থেকেই বিশ্বের বহুদেশে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। আমাদের দেশে ভাল টাকাও বিনিয়োগের বাস্তবতা নেই। এ পরিস্থিতি কারো জন্যই সুখকর বা কাম্য নয়।
দেশে শিল্পবিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হলে বা বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি না হলে তার বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব সর্বত্র পড়তে বাধ্য। জাতীয় আয় জাতীয় সঞ্চয় থেকে শুরু করে সর্বত্রই মন্দাভাব বিরাজমান। ফলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। সরকার মুখে উন্নয়নের কথা বলছে, অন্যদিকে সরকারের লিখিত অলিখিত নানা চাপে শিল্প-উদ্যোক্তারা হতাশ হচ্ছেন। একটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রয়োজনেই শিল্পের সংকট দূর করতে হবে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রফতানি বাড়াতে হবে। উদ্যোক্তারা যদি হতাশাগ্রস্ত হন, নতুন বিনিয়োগ হাত গুটিয়ে রাখেন, তবে অর্থনীতিতে সমূহ বিপর্যয় অনিবার্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন