Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চড়া সুদে বিশ্বব্যাংকের ঋণ

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ১৬ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে তিনটি প্রকল্পের জন্য চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছে সরকার। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ঋণের পরিমাণ ৩০ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংকের নতুন ঋণ কর্মসূচি স্কেল আপ ফ্যাসিলিটি (এসইউএফ)-এর আওতায় এ ঋণ নেয়া হচ্ছে। এতে সুদের হার হবে আড়াই শতাংশের বেশি। এই ঋণের রেয়াতি সময় কম এবং ঋণচুক্তি কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে ‘ফ্রন্ট অ্যান্ড ফি’র নামে ঋণের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব¦ব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বল্পসুদে নমনীয় ঋণ নিয়ে আসছে। এই ঋণের সুদ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ। এতে রেয়াতি সময় ১৫ থেকে ২০ বছর এবং পরিশোধের সময়সীমা ৩০ থেকে ৪০ বছর। পক্ষান্তরে ইআরডির সূত্র মতে, এসইউএফ কর্মসূচির আওতায় নেয়া ঋণের শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ফ্রন্ট অ্যান্ড ফি ছাড়াও অনুত্তোলিত ঋণের ক্ষেত্রে কমিটমেন্ট ফি হিসাবে আরো শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ দিতে হয়। ফলে সুদের হার সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৫৭ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। জানা যায়, এই নতুন ঋণ কর্মসূচি গত বছর থেকে চালু করা হয়েছে। আইডিএ’র উদ্বৃত্ত তারল্য থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এই এসইউএফ ঋণ ফান্ড গড়ে তোলা হয়েছে। এই ঋণ কর্মসূচির আওতায় আইডিএ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নির্ধারিত ও নমনীয় উভয় হারে এবং আইডিএ স্বীকৃত দেশগুলোকে শুধুমাত্র নির্ধারিত সুদে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া আছে। বাংলাদেশ আইডিএ স্বীকৃত দেশ হওয়ায় তাকে নির্ধারিত সুদহারেই ঋণ নিতে হবে। ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই এই ঋণ নেয়ার ব্যাপারে অনুমোদন দান করেছেন।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী যে তিনটি প্রকল্পের জন্য এই অনমনীয় ও উচ্চ সুদের ঋণ নেয়া হচ্ছে সে তিনটি প্রকল্প হলো : ডেভেলপমেন্ট হাই প্রটেনশিয়াল সেক্টরস এক্সপোর্ট, বাংলাদেশ পাওয়ার সিস্টেম রিলায়্যাবিলিটি অ্যান্ড এনার্জি এফিসিয়েন্সি ইনপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট এবং ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড ফাইন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি প্রজেক্ট। সন্দেহ নেই, প্রকল্প তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন আবশ্যক। প্রশ্ন হলো : বিশ্বব্যাংকের এই অনমনীয় ঋণ ছাড়া বিকল্প কোনো ঋণে কি প্রকল্প তিনটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়? বিশ্বব্যাংক বা অন্য কোনো অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার যথাযথ চেষ্টা কি করা হয়েছে? আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের নমনীয় ঋণ কর্মসূচি রয়েছে। ওই সব কর্মসূচির আওতায় ঋণ নেয়া হলে সুদের হার যেমন কম হতে পারে, তেমনি ঋণ পরিশোধের জন্য পর্যাপ্ত সময়ও পাওয়া যায় এবং শর্তাদিও কম থাকে। এসইউএফ কর্মসূচির আওতায় ঋণ নেয়ার আগে বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা দাতা দেশগুলোর কাছে এ ব্যাপারে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কি না, হলে কী রকম সাড়া পাওয়া গেছে সেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই ভালো বলতে পারে। ঋণের কম-বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছেই। সবচেয়ে ভালো হয় ঋণ না নেয়া। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি এখনো এতটা মজবুত হয়ে ওঠেনি যে, ঋণ ছাড়া আমরা সব উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের সামর্থ্য রাখি। সামর্থ্যরে অভাবের কারণে আমাদের বা আমাদের মতো দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ও দাতা দেশের কাছে ঋণের জন্য ধরনা দিতে হয়। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায়  নেই। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে তাই এই বিবেচনা সব সময়ই প্রাধান্যে রাখা দরকার যে, সেই ঋণই নেয়া হবে যা কম সুদের, কম শর্তের এবং পরিশোধের সময়সীমা যার বেশি।
ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়ার একটা প্রবাদ আমাদের দেশে চালু আছে। ঋণ নিয়ে ঘি খাওয়া যায় বা সম্ভব। কিন্তু ঋণের অর্থে ঘি খাওয়ার পরিণাম কখনো ভালো হয় না। শেষ পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। আমরা জানি, প্রতি বছরের বাজেটে দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য একটা বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। সেটা অগ্রাধিকারভিত্তিক অনেক খাতের বরাদ্দের চেয়েও বেশি। সরকার দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নেয় দু’হাতে। বর্তমান সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। তুলনামূলক বিচারে হয়তো দেখা যাবে, এ সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে। সরকার যে ঋণই নিক বা যত ঋণই নিক, এর বোঝা কিন্তু জনগণের ঘাড়েই চাপে এবং তাদেরই তা বংশপরম্পরায় বহন করতে হয়। ২০১২-১৩ অর্থ বছরের একটি হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, ওই বছরের জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় এক লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১২ হাজার ৭০০ টাকা। এই ক’বছরে সাকুল্য বৈদেশিক ঋণের পরিমাণসহ মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ আরো বাড়ার কথা। এভাবে দেশের ও মানুষের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপিয়ে প্রত্যাশিত উন্নয়ন দ্রুতায়িত করা যায় না। লাভের ধনের একটা বড় অংশই চলে যায় পিঁপড়ার পেটে। তাই নিতান্ত জরুরি বা প্রয়োজন না হলে ঋণ গ্রহণ করা উচিত নয়। আর অত্যধিক সুদে ও শর্তে তো নয়ই। এই বিবেচনায় বিশ্বব্যাংকের এসইউএফ কর্মসূচির আওতায় ঋণ নেয়া কতদূর সঙ্গত হবে, সেটা আরেকবার ভেবে দেখা উচিত। বিকল্প কোনো উৎস থেকে নমনীয় কোনো ঋণ পাওয়া যায় কি না সেটা আরোএকবার খোঁজখবর ও যাচাই করে দেখার জন্য আমরা অনুরোধ জানাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন