Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হালদা নদী রক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৫ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের মিঠাপানির জাতীয় মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র বা মাছের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত হালদা নদী ক্রমেই করুণ দশায় উপনীত হচ্ছে। বিরামহীন মারাত্মক দূষণ, ভরাট, বেদখল, নদীর গতিপথে বিভিন্ন রকমের বাধা-বিপত্তি, বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য, উজানে তামাক চাষের বর্জ্য, কীটনাশকের ব্যবহার মাছের প্রাকৃতিক ‘জিন ব্যাংক’ খ্যাত নদীটিকে বিপন্ন করে তুলেছে। বহুদিন ধরেই নদীটিকে নিয়ে এ অনাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাকিদ দেয়া হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এতে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, অচিরেই নদীটি তার স্বাভাবিক চরিত্র হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি তাই হয়, তবে এর চেয়ে অপূরণীয় ক্ষতি আর কিছুই হতে পারে না। কারণ, এটা কোনো মনুষ্য সৃষ্ট সম্পদ নয় যে নষ্ট হয়ে গেলে পুনরায় গড়ে তোলা যাবে। এটি প্রকৃতির অপার দান। প্রকৃতিই একে সমৃদ্ধ করে সৃষ্টি করেছে। সম্পদে ভরপুর এমন নদী বিশ্বে খুব কমই রয়েছে। বিশ্বের নদী গবেষকদের কাছে এটি যেমন এক বিস্ময়, তেমনি এ নিয়ে তাদের ক্রমাগত গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্রও বটে। বলা হয়, এশিয়ার একমাত্র জোয়ার-ভাটা নির্ভর নদী এটি। এ থেকে সরাসরি রুই, কাতলা, মৃগেল জাতীয় মিঠাপানির মাছের ডিম সংগ্রহ করা হয়। ডিম থেকে ফোটানো রেণু-পোনা জেলেদের হাতবদল হয়ে সারা দেশে মাছচাষি ও খামারীদের কাছে পৌঁছে যায়। এ নদীর ডিম বা রেণু-পোনার মৃত্যুহার খবই কম এবং তা দ্রুত বধর্নশীল। রুই-কাতলা ছাড়াও ৫০টির বেশি প্রজাতির মাছের প্রকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রকৃতির এমন বিস্ময় এবং দান হালদা নদী ধ্বংসে যত ধরনের অপকর্ম রয়েছে, তার সবই সংঘটিত হচ্ছে। একে রক্ষার কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
প্রকৃতি যে সম্পদ দিয়েছে, তা আমরা রক্ষা করে ভোগ করতে পারছি না। বরং কীভাবে তা ধ্বংস করে চিরতরে নিঃশেষ করা যায়, তার জন্য অনেকটা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। সুন্দরবন ধ্বংসে যে ধরনের অপকর্ম চলছে, তাতে এ বনটি ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রকৃতির এমন দান বিশ্বের খুব কম দেশেই রয়েছে। দুঃখের বিষয়, আমরা পেয়েও তা রক্ষার বদলে ধ্বংস করে দিচ্ছি। আরেকটি সুন্দরবন আমরা পাব কিনা, তা নিয়ে ভাবছি না। তদ্রƒপ প্রকৃতির অনন্য উপহার হালদা নদী নিয়েও যে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তা চলতে থাকলে যে অপূরণীয় ক্ষতি হবে এবং আরেকটি হালদা নদী যে সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, তা চিন্তা করছি না। একটি নদী কত দিক থেকে যে উপকারী হতে পারে, তা হালদা নদীর বৈশিষ্ট্য না বুঝলে বোঝানো যাবে না। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নদীটির প্রত্যক্ষ অবদান বার্ষিক ৮০০ কোটি টাকা। ফল-ফসল, কৃষি খামারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর অবদান কয়েক হাজার কোটি টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় এক লাখ মানুষের। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম মহানগরী ও শহরতলীসহ নদীটির আশপাশ এলাকার প্রায় ৭০ লাখ অধিবাসীর জন্য সুপেয় পানির প্রধান উৎস হয়ে আছে নদীটি। চট্টগ্রাম ওয়াসা মোহরা পানি শোধনাগারের মাধ্যমে নদীটি থেকে প্রতিদিন ৪ কোটি গ্যালন পানি উত্তোলন করে নগরবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করছে। একক নদী হিসেবে এত বহুমুখী উপকারী নদী বাংলাদেশে কেন সারাবিশ্বেই বিরল। অথচ অমূল্য সম্পদ এ নদীকে দিন দিন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। ক্ষত-বিক্ষত করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ নদী থেকে ১৯৪৫ সালে আহরিত ডিম থেকে আড়াই হাজার কেজি রেণু-পোনা উৎপাদিত হতো। মাছের প্রজনন ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নদীটির পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে। ডিম ছাড়ার হারও আশঙ্কাজনক হারে কমছে। এখন বছরে পাওয়া যায় মাত্র ৮ থেকে ১০ কেজি। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, নদীটির উপর দিন দিন মানুষের অত্যাচার কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, হালদাকে ধ্বংসে বছরের পর বছর ধরে এক ধরনের মহোৎসব চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হালদা গবেষকরা বলছেন, শুধু ধ্বংসাত্মক কর্মকা- নয়, এর স্বাভাবিক গতিপথও বিভিন্নভাবে বদলে দেয়া হচ্ছে। নদীপথে রাবার ড্যাম ও বাঁক সৃষ্টি করে এর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘিœত করা হয়েছে। এর গতিপথের প্রায় ১৫ কিলোমিটার শুকিয়ে যাচ্ছে, চর জাগছে। ৯৮ কিলোমিটার গতিপথে মারাত্মক দূষণ ঘটছে। একটি প্রাকৃতিক জাতীয় সম্পদকে এভাবে বিনষ্ট করার প্রক্রিয়া বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, আমাদের জানা নেই। এসব কিছুই ঘটছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নাকের ডগায়।
জাতীয় জীবনে অসামান্য অবদান রক্ষাকারী হালদা নদীকে বাঁচাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ নদীকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা, বাংলাদেশের অদ্বিতীয় নদী হিসেবে জাতীয় প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক নদী হিসেবে সংরক্ষণের ঘোষণা দেয়া জরুরী। দখল, দূষণসহ এর গতিপথ বদলে দেয়ার যেসব অপকর্ম চলছে, তা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা গ্রহণ করে আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং নদী তীরবর্তী জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে অবিলম্বে একে সুরক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে যা যা করণীয়, তার সব উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রকৃতির এই অসামান্য অবদান একবার নষ্ট হয়ে গেলে, তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সরকার যেসব প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পন্ন করছে হালদা নদী রক্ষায়ও সেরকম সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ নিয়ে কোনো হেলাফেলা করা যাবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন