Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানি সংকটে দেশের নদ-নদী

সম্পাদকীয়-২

| প্রকাশের সময় : ১৪ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

উজানে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার বিশাল অংশ এবং এর বহুসংখ্যক শাখানদী ইতিমধ্যে শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধের কারণে তিস্তাও এখন পানিশূন্য। পানির অভাবে দেশের অন্যতম বৃহৎ তিস্তা সেচ প্রকল্প ক্রমে অকার্যকর ও পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তিস্তা সেচ প্রকল্পের আওতাধীন বিশাল এলাকার প্রায় অর্ধেক কৃষিজমি সেচসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত রিপোর্টে একসময় দেশের অন্যতম বিশাল-প্রমত্তা নদী যমুনার দৈন্যদশা উঠে এসেছে। সাধারণত বৈশাখ মাসে দেশের অনেক আভ্যন্তরীণ ছোট নদীর পানি কমে ‘হাঁটু জল’-এ নেমে আসে। সে সব নদ-নদী হারিয়ে যাওয়ার পর এখন যমুনার মত বিশাল নদী পৌষ মাসেই হাঁটু জল নয়, শুকনো মরুভূমিতে পরিণত হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ এবার চৈত্রের আগেই যমুনাসহ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের অধিকাংশ নদীর বুক ধু ধু মরুভূমিতে পরিণত হবে। গত চল্লিশ বছর ধরে চলা ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের চরম রূপ এখন বাংলাদেশের কৃষি,জীব-বৈচিত্র্য, নৌ-যোগাযোগ ও সামগ্রিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দেশের সেচ ব্যবস্থা বহুলাংশে ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে এখনো সরাসরি তার নেতিবাচক প্রভাব তেমন তীব্র আকারে দৃশ্যমান হয়ে না উঠলেও ইতিমধ্যে দেশের বহু এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গিয়ে অনেক সেচপাম্প অচল হয়ে পড়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর অতি নির্ভরতার কারণে দেশের ভূ-প্রকৃতি আভ্যন্তরীণ ভারসাম্য হারাতে বসেছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আমরা যখন দশকের পর দশক ধরে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন এবং ভারত কর্তৃক পানি বঞ্চনার কথা বলছি, ভারত তখন প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্কের কথা ভুলে, আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন লঙ্ঘন করে আমাদের প্রায় সবগুলো নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানি বণ্টনের অব্যাহত দাবীর প্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের কাছে ভারতের পক্ষ থেকে কাক্সিক্ষত প্রায় সব দাবী পূরণ করার পরও তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ চলছেই। ভারতের বিগত কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং,  প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি এবং বিজেপি সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার বার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির আশ্বাস দেয়ার পরও বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ অপেক্ষা করেই চলেছে। গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়, তিস্তার পানি প্রবাহ এখন ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্তরে ঠেকেছে। রিপোর্টে জানা যায়, সত্তুরের দশকের মাঝামাঝি থেকে মধ্য আশির দশক পর্যন্ত যেখানে তিস্তায় নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে জানুয়ারীর প্রথম ১০ দিনে তিস্তার গড় প্রবাহ ছিল ৭ হাজার ১০ কিউসেক, সেখানে গত বছর এ সময়ে তা’ ৪ হাজার ৩১৬ কিউসেকে নেমে আসে। আর চলতি জানুয়ারীর প্রথম ১০ দিনে তিস্তার গড় প্রবাহ দাঁড়িয়েছে  মাত্র ২ হাজার ৭০০ কিউসেক। অথচ তিস্তার নাব্যতা ধরে রাখতে এবং তিস্তা ব্যারাজ চালু রাখতে কমপক্ষে সাড়ে ৮ হাজার কিউসেক পানি প্রয়োজন। যৌথ নদী কমিশনের পুরনো রিপোর্ট অনুসারে তিস্তার গড় প্রবাহের মাত্র ৬ শতাংশ পাচ্ছে বাংলাদেশ। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একদিকে ভারতে রাজনৈতিক রশি টানাটানি হচ্ছে, অন্যদিকে শুকনো মওসুমের শুরুতেই গজলডোবা বাঁধের সবগুলো গেট বন্ধ করে দিয়ে বাংলাদেশের বিশাল অংশকে শুকিয়ে মারছে। তারাই আবার পাহাড়ি ঢলে বেড়ে যাওয়া পানির চাপ সামাল দিতে যখন তখন তিস্তার সøুইস গেট খুলে দিয়ে বাংলাদেশের বিশাল জনপদে অকাল বন্যা ও নদী-ভাঙনের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের যেন কিছুই করণীয় নেই, ভারতের পানি আগ্রাসনের কাছে আমরা বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছি।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের কৃষকদের এ কৃতিত্ব নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো আত্মতুষ্টি ও রাজনৈতিক বাগাড়ম্বরে লিপ্ত থাকলেও আগামী দিনের কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, জীব-বৈচিত্র্য ও সম্ভাব্য পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। এমনকি চরম বৈরী প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো অভিন্ন নদীর উপর এমন একতরফা কর্তৃত্ব ও পানি আগ্রাসন চালানোর ঘটনা সমকালীন বিশ্বে বিরল। লোক দেখানো একটি যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠিত হলেও ভারতের অনিচ্ছায় বছরের পর বছর ধরে এই কমিশনের কোন বৈঠক হয়না। নামমাত্র গঙ্গার পানিচুক্তি হলেও সেই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ পানি পাচ্ছেনা। জেআরসি বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য দাবীর প্রাপ্যতার মূল্যায়ন করতেও তারা রাজি নয়। অথচ এসব পানি সমস্যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কযুক্ত। এক রিপোর্টে জানা যায়, দেশের উত্তরাংশের দেড়শতাধিক নদী এবং ২ লক্ষাধিক পুকুর ও জলাভূমি এখন পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। এর ফলে কৃষিতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা তো আছেই, ইতিমধ্যে কয়েক লাখ মৎস্যজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। এহেন বাস্তবতা সামনে রেখে আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যাচ্ছেন। তিস্তাসহ অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোন জোরালো পদক্ষেপ দেশবাসীর কাছে দৃশ্যমান নয়। এ ব্যাপারে দেশের মানুষ সর্বোচ্চ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তৎপরতা দেখতে চায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন