Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদী শুকিয়ে মরা গাঙ

শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই সেচ সঙ্কট, জেআরসি’র বৈঠক বসছে না ৭ বছর

| প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই দেশের নদীগুলো শুকিয়ে মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে প্রধান প্রধান নদীগুলোর নৌপথ সচল রাখা হয়েছে। তীব্র সেচ সঙ্কটে বোরো আবাদের জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, সেচের পানির অভাবে কৃষক ধান ফলানোর পরিবর্তে ঝুঁকছে অন্য ফসলের দিকে। এমন পরিস্থিতির উত্তরণে যৌথ নদী কমিশনের  (জেআরসি) বৈঠক যেখানে অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে; সেখানে প্রায় সাত বছর ধরে বন্ধ রয়েছে জেআরসি’র বৈঠক।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে জানা গেছে, অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে দিল্লির আপত্তি এবং রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার অভাবেই জেআরসি’র বৈঠক বসছে না। যার বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই পদ্মা এখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’-তে পরিণত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও  মেঘনা নদীর অবস্থাও একই।
নদীপারের মানুষগুলোর অভিযোগ, রবি ঠাকুরের ছোট নদীতে বৈশাখ মাসে অন্তত হাঁটু পানি হলেও থাকত। আর এখন দেশের প্রধান প্রধান সকল নদ-নদী জুড়েই হাঁটু পানি। অসংখ্য নদী মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। নদীতে পানি নেই। শুষ্ক মৌসুমের দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীগুলোর অবস্থাই যেখানে এরূপ; সেখানে গড়াই, ফেনী, মুহুরি, সুরমা, কুশিয়ারা ও তিস্তা নদীর অবস্থা আরও করুণ। এসব নদী নির্ভর সেচ প্রকল্পগুলোর অবস্থাও শোচনীয়। পানির অভাবে তিস্তা, জিকে, মুহুরি, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পে এবার সেচযোগ্য জমির পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতির এই ভয়াবহতা নিরূপণে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় একেবারেই ব্যর্থ। যার চরম মূল্য দিচ্ছে এদেশের কৃষকরা।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৪শ’ কিলোমিটার নদী সীমান্ত রয়েছে। এসব নদী সীমান্তের অধিকাংশ জায়গায় ভাঙন দেখা দিলেও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র বাধার কারণে প্রতিরোধ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিশেষ করে, মহানন্দা, সুরমা, কুশিয়ারা, মুহুরি, ফেনী, তিস্তা, ইছামতি ও পদ্মা নদীর ভাঙনে দেশের মূল্যবান ভূমি ভারতীয় অংশে চলে যাচ্ছে। ভারতীয় অংশে জেগে উঠা ভূমি ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ দীর্ঘ এক যুগ ধরে বিভিন্ন বৈঠকে উপস্থাপন করলেও এতে দিল্লির সাড়া মেলেনি। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত নদী সংক্রান্ত সমস্যাদি সমাধানে বছরের পর বছর জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক কেন হচ্ছে নাÑ এ নিয়ে পানি বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন।
জেআরসি’র মন্ত্রী পর্যায়ের সর্বশেষ ৩৭তম বৈঠকটি বসেছিল ২০১০ সালে মার্চে দিল্লিতে। আর ৩৮তম বৈঠকটি হওয়ার কথা ঢাকায়। ইতোপূর্বে ২০১৩ সালের ১৮-১৯ জুন ঢাকায় জেআরসি’র ৩৮তম বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছিল। ওই সময় ভারতে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় ছিল। কিন্ত প্রস্তুতির প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে দিল্লির পক্ষ থেকে বৈঠকটি বাতিল করা হয়। কেন এবং কী কারণে এই বৈঠক বাতিল করা হয়েছিল তার বিশেষ কোনো কারণও বাংলাদেশকে জানানো হয়নি। তবে বাংলাদেশ ধরে নিয়েছিলÑ ওই সময় ভারতে নির্বাচন থাকায় বৈঠকটি হয়নি।
পরবর্তীতে ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রী জেআরসি’র বৈঠক অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে একটি চিঠি পাঠায়। এর জবাবে ভারতের পানিসম্পদ ও নদী উন্নয়ন মন্ত্রী উমা ভারতী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়, আপাতত জেধারসি’র বৈঠকে অংশ নেয়া সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে এই চিঠিটি পাঠানো হয়। ওই সময় পানিসম্পদমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে উমা ভারতী জানান, বর্তমানে ভারতের সংসদে বাজেট অধিবেশন চলছে। পরবর্তীতে পারস্পরিক সুবিধামত সময়ে বাংলাদেশে সফরে আসবো। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় উল্লেখ করে চিঠিতে তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে বহুমুখী সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৯৭ সালের গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি তার একটি প্রমাণ।
পানি সম্পদমন্ত্রীকে এমন চিঠি দিলেও জেধারসি’র বৈঠকের দিনক্ষণ আজও জানাননি উমা ভারতী। ফলে জেধারসি’র বৈঠক না হওয়ায় দু’দেশের মধ্যে আটকে আছে ৫৪টি অভিন্ন নদী সংক্রান্ত অনেক অমীমাংসিত সিদ্ধান্ত।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহা-পরিচালক হাবিবুর রহমান জানান, তিস্তায় যে হারে পানি কমে আসছে, এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তীব্র পানি সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। তিস্তায় ভয়াবহ পানি হ্রাসের ফলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে সেচ কাজের ব্যাঘাত ঘটবে। এছাড়াও পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর পানি হ্রাস আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে শাখা নদীগুলোর উপরে।
জানা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ড তিস্তা প্রকল্পে সেচযোগ্য জমির পরিমাণ ১০ হাজার হেক্টরে নামিয়ে এনেছে। এছাড়া নীলফামারীর তিন উপজেলার বাহিরে তিস্তার সেচ ক্যানেলে পানি সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ তিস্তায় স্বাভাবিক পানি প্রবাহ থাকলে সেচযোগ্য জমি দাঁড়াতো ৬৬ হাজার হেক্টরে। গেল বছর তিস্তায় সর্বনিম্ন পানি ছিল ৩০০ কিউসেক। আর ২০১৫ সালে পানির সর্বনি¤œ রেকর্ড ছিল ২৪০ কিউসেক। এবার তিস্তায় সর্বনিম্ন পানি কত পাওয়া যাবেÑ তা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয় প্রশাসনসহ নদী অববাহিতার কৃষকরা।
ভারতের সাথে জেধারসি’র বৈঠক অনুষ্ঠানে কেন বিলম্ব হচ্ছে জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সাবেক সদস্য ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, অভিন্ন নদীগুলোর পানি প্রবাহ বাড়ানোর জন্য কি করা যেতে পারে এবং কিভাবে এই পানি বণ্টন হবে, তা নিয়ে দুদেশের মধ্যে ঐকমত্য নেই। তাছাড়া রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনারও অভাব রয়েছে। যার কারণেই দীর্ঘ প্রায় সাত বছর যাবত জেধারসি’র বৈঠক বসছে না। তিনি জানান, তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানি পাওয়াটা বাংলাদেশের অধিকার। অথচ গজলডোবা বাঁধের মাধ্যমে ভারত এই পানি আটকিয়ে রাখছে। আবার বর্ষায় পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ অংশে সমস্যার সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, তিস্তাসহ অভিন্ন সকল নদী নিয়ে ভারতের সাথে চুক্তি হলে এমনটি হতো না।



 

Show all comments
  • selina ১২ জানুয়ারি, ২০১৭, ১১:০৯ এএম says : 0
    no natural water flow in river of the country no Bangladesh . today Thursday ,12th Jan 2017 at dawn in northern part of the country suddenly shows like dry season .
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ