Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কর্মসংস্থানে নজর দেয়া জরুরি

সম্পাদকীয়-১

| প্রকাশের সময় : ১১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনায় দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য উদ্বেগজনক আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বছর বছর দেশের কৃষি ও শিল্প খাতে শ্রমিকের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। এ দুই খাতে যে হারে মজুরি বাড়ছে তার চেয়ে বেশি হারে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। ফলে শ্রমিকরা কিছুটা বাড়তি মজুরি পেলেও দেখা যাচ্ছে তাদের মোট আয় দিয়ে আগের চেয়ে কম পরিমাণ পণ্য ও সেবা কেনা যাচ্ছে। এই পর্যালোচনায় আরো দু’টি চিত্র উঠে এসেছে যাকে খুবই অস্বস্তিকর বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ দু’টি হলো দেশের ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ২৫ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়। তারা কর্মবাজারেও নেই, শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণও নিচ্ছেনা। এদের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ। আরেকটি চিত্র হচ্ছে, দেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এ সংক্রান্ত আলোচনায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এখন দেখা যাচ্ছে, যতবেশি শিক্ষা গ্রহণ করছে, বেকারত্বের হার তত বাড়ছে। নিষ্ক্রিয় বেকারের হারকে তিনি ভয়ংকর বলে অভিহিত করেছেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আলম বলেছেন, মানুষ চাকরি খুঁজে মরছে, আর শিল্পে লোক পাওয়া যাচ্ছে না। এটা একটা কাঠামোগত সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার বলে তিনি মনে করেন। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেছেন সব মিলিয়ে সুশাসনের বিষয়টি চলে আসে।
দেশের অর্থনীতির প্রধান দুই খাত কৃষি ও শিল্প। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, দেশ এখনো বেঁচে আছে মূলত কৃষকের জন্যই। কৃষিতে দিনদিন মজুরি কমে আসার অর্থ হছে কৃষক নিঃস্ব হচ্ছে। সেমিনারের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, ২০১৪-১৫ সালে দেশে কৃষিখাতে মজুরি বেড়েছে ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে এখাতে প্রকৃত মজুরি কমেছে। তিনি তার প্রতিবেদনে চার বছরের হিসাব তুলে ধরেছেন। এতে দেখা যায়, প্রতিবছরই কৃষি ও শিল্প খাতে প্রকৃত মজুরি কমেছে। কারণ, প্রতিবছরই এ দু’টি খাতে মজুরি বৃদ্ধির চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি ছিল। শ্রমবাজার পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, জরিপ অনুযায়ী দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৩৪ লাখ। এদের ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমবাজারে নেই, শিক্ষায় নেই ও প্রশিক্ষণও গ্রহণ করছে না। জরিপের হিসাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার ছেলেদের চেয়ে কম। এই চিত্র উদ্বেগজনক। কারণ, বেকার মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। বেকারদের যথাযথ কাজে লাগাতে না পারলে যেকোন অনাসৃষ্টির আশঙ্কা যেমনি থাকে, তেমনি এত বিপুলসংখ্যক বেকারত্বের ফলে দেশের সম্ভাবনাও হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। দেশে শিক্ষিতদের বেশি হারে বেকার থাকার বিষয়টিকে বর্তমানে শিল্প উদ্যোক্তারাও গভীর বিবেচনায় দেখছেন। তারাও মনে করেন দেশে উচ্চ শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে অথচ দেশে বিদেশিদের অধিক বেতন দিয়ে আনতে হচ্ছে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য। তারা মনে করছেন প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত যোগ্য ও দক্ষ শ্রম শক্তির অভাব রয়েছে দেশে। এজন্য তারা শিক্ষামানের প্রসঙ্গও তুলেছেন। তারা মনে করছেন, আমাদের দেশে সার্টিফিকেট ও মানের মধ্যে সমন্বয় নেই। ফলে ইচ্ছা থাকলেও প্রয়োজনীয় জনশক্তি নেয়া যাচ্ছে না। একথা কার্যত নতুন নয়। শিক্ষা নিয়ে আমরা যত গর্বই করি না কেন এটা দেখা যাচ্ছে দেশ-বিদেশ সর্বত্রই শিক্ষারমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন কি বিদেশে লোক পাঠাবার বেলায়ও দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির প্রসঙ্গ থাকলেও সে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিষয়টি উদ্বেগজনক, কারণ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর যদি তা কোন কাজে না লাগে বা লাগানোর মত বাস্তবতা না থাকে তাহলে তা জাতীয় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। কেন এ অবস্থা তা অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে। অন্যভাবে বলা যায়, দেশের উচ্চশিক্ষিতরা যদি বেকার থাকে তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নতির হাল ধরবে কারা ? দেশের কৃষি এবং শিল্পীয় শ্রমিকদের অবস্থা যদি ক্রমাগতভাবে নাজুক হতে থাকে তাহলে অবশ্যই তার বিরূপ প্রভাব পড়বে উৎপাদন ব্যবস্থার উপর, ব্যাহত হবে কৃষি এবং শিল্প উৎপাদন। এই প্রবণতা কার্যতই জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতে গভীর বিবেচনার দাবি রাখে।
মূল্যস্ফীতি যেমনি একটি নিয়মিত ব্যাপার তেমনি মজুরি বৃদ্ধিও নিয়মেরই অংশ। মূল্যস্ফীতির একটি বাৎসরিক হার বিশ্বব্যাংক প্রকাশ করে থাকে। কোন অস্বাভাবিক বাস্তবতা না থাকলে মোটামুটি এটাকেই সূচক ধরে এগুনো হয়। আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানের একটি বড় ব্যাপার এখানে রয়েছে। একথা অস্বীকার করা যাবে না কেবল মজুরি বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিধান করা সম্ভব নয়। বিনিয়োগ, উৎপাদন আয়-উন্নতি কর্মসংস্থান সবকিছুর উপর নির্ভর করছে মজুরি নির্ধারণ। যে কর্তৃপক্ষ মজুরি প্রদান করবেন তাদের সামর্থ্যরে বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচ্য। এখানে কাউকে খুশি করার ব্যাপার নেই বরং বিষয়টি জাতীয় অর্থনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, জবাবদিহিতা না থাকার কারণে গত কয়েক বছরে কোন কোন মহলকে খুশি করতে এক ধরনের ‘তোষামোদি’ বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হচ্ছে- যার মাশুল দিতে হচ্ছে গোটা দেশবাসীকে। এখানেই মূলত সুশাসনের প্রসঙ্গ বড় হয়ে দেখা দেয়। দেশে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এবং জবাবদিহিতা না থাকাতেই এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা স্থান করে নিয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাবই হচ্ছে এসব। এ প্রবণতা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। দেশের অর্থনীতিতে দেশের তরুণ ও শিক্ষিত শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করা না গেলে অর্থনীতি আরো পরনির্ভরশীল হয়ে পড়তে বাধ্য। সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি বোধের মধ্যে নেবেন- এটাই দেশবাসী প্রত্যাশা করে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন