বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
হারুন-আর-রশিদ : ২০১৬ জানুয়ারির প্রথম দিনটি ছিল- শুক্রবার অন্যদিকে ২০১৬ শেষ দিনটি শনিবার ৩১ ডিসেম্বর। এই ৩৬৫ দিনের বাংলাদেশ কেমন ছিলÑ বিশেষ করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক পরিস্থিতি। শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি যা বিশ্লেষকরা তাদের গবেষণায় তুলে ধরেছে। দেশের সচেতন মানুষ বলেছেÑ দৃশ্যত পরিবেশ মোটামুটি শান্ত ছিল। বিশেষ করে দেশের রাজনীতিক পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল। দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল থেকে কোনো বড় ধরনের কর্মসূচি আসেনি। তারা কর্মসূচি দিলেও মাঠে নামতে পারেনি। নানা চাপের মধ্যে বিএনপিকে ১২টি মাস পার করতে হয়েছিল। যার কারণে দেশে পুরো বছর জুড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করেছিল। দেশে কোনো বিরোধী দল আছে বলে মনে হয়নি। গৃহপালিত বিরোধী দলটিকে মনে হচ্ছিল সরকারেরই একটি অঙ্গসংঘটন। ৩ জন মন্ত্রী একজন বিশেষ দূত-পদ নিয়ে থাকা দলকে কোনোভাবেই বিরোধী দল বলে গণ্য করা যায় না। ৩৬৫ দিনে দেশের মানুষ কতজন গুম হয়েছে, ক্রস ফায়ারে নিহত হয়েছে, কত মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছে এবং কতজন নারী ও শিশু ধর্ষিত হয়েছে একদিনও তার একটি হিসাব তুলে ধরেনি জাতীয় সংসদে। কেন মানুষ বেওয়ারিশ লাশ হয়, বিনা বিচারে খুন হয়, পুলিশ হেফাজতে নিহত হয়, এসব ব্যাপারে কথিত বিরোধী দলের কোনো জোরালো বক্তব্য সংসদে ছিল না। ৪৫ টাকা কেজি চিনি কেন ৮০ টাকা হলো, লবণের দাম কেন বাড়লো, দুই দফা গ্যাসের দাম কেন সরকার বাড়ালো, বিদ্যুৎ পানি; হোল্ডিং ট্যাক্স বিগত এক বছরে এক থেকে দেড়গুণ কেন বাড়লো? বিগত এক বছরে বাসের ভাড়া বৃদ্ধি কেন হলো এসব ব্যাপারে কথিত বিরোধী দলের কোনো বক্তব্য ছিল না। সেহেতু বিগত এক বছরের মধ্যে একদিনও জাতীয় সংসদকে কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র হিসাবে আখ্যায়িত করা যায় না। সংসদকে মনে হয়েছিল ব্যক্তিগত বৈঠকখানা। যে সংসদে জনগণের কথা থাকে না, থাকে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি আর মাঠের বিরোধী দলের কঠোর সমালোচনা, সে সংসদকে কর্তৃত্ববাদী এক দলীয় সংসদ হিসাবে ধরে নেয়া যায়।
বিদায়ী বছরের ঘটনাবলি নিয়ে ২৯ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে কথা বলেছেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেছেন পুরো বছর ধরে দৃশ্যত শান্ত অবস্থা দেশে বিরাজ করলেও মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করেছে। কার্যকর বিরোধী দল সংসদ ও সংসদের বাহিরে না থাকায় জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বলার কোনো সুযোগ ছিল না। শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ কথাও বলেছেন- দেশে মত প্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হয়েছে। এ সময় মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করেছে। জনগণকে অনেকটা অসহায় অবস্থায় দেখা গেছে পুরো বছর জুড়ে। একটি গতানুগতিক বছর যেখানে নতুন কিছু পরিলক্ষিত হয়নি বরং দেশের সামাজিক ও নৈতিক চিত্র অনেক খারাপ হয়েছে। কুমিল্লার সেনানিবাসে তনু হত্যা বছর জুড়ে গোটা দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।
একটি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল যদি সংসদে রাজপথে ও নির্বাচনে না থাকে তাহলে গণতন্ত্র থাকে না। প্রধান বিরোধী দল স্থানীয় সরকারের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ৫টি বিভাগীয় সিটি নির্বাচনে জয় লাভ করার পর তাদেরকে মামলায় জড়িয়ে জেলে ঢুকানো হয়। অনেকে বলেছেন নাসিক নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল জিতলেও সেই একই কায়দায় জেলে ঢুকানো হতো। নারায়ণগঞ্জে বিরোধী দল অংশ নিলেও সেখানে আশানুরূপ ভোট জনগণ দেয়নি। অন্যদিকে জেলা পরিষদ একদলীয় হয়ে গেছে। সেখানে সরকারি দলের মধ্য থেকে বিদ্রোহী গ্রুপ প্রার্থী থাকায় প্রচুর সহিংসতা হয়েছে। গোলাগুলির ঘটনাও ঘটেছে। জাতীয় নির্বাচনের কথা বাদই দিলাম শুধু স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে সহিংস ঘটনায় এবং পুলিশের গুলিতে নিহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। সংসদীয় গণতন্ত্রের এ ধরনের ঘটনা গোটা বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রে দেখা যায়নি। প্রতিটি নির্বাচনে টাকার খেলা হয়েছে। যার বেশি টাকা সেই স্থানীয় ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে জিতেছে। সরকারি দল এককভাবে এসব কর্মকা- করেছে। বিদায়ী বছরে জঙ্গিবাদ দেশে জেঁকে বসেছিল। রাজনীতিতে নতুন উপসর্গ ছিল জঙ্গিবাদ। ইংরেজী শিক্ষিত ছেলে-মেয়েরা এবং বিত্তবান পরিবারের সন্তানরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জঙ্গিবাদ উত্থানের কারণ হিসেবে বলেছেন- প্রকাশ্য রাজনীতি না থাকলে দেশে অদৃশ্য ঘটনার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নেই। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকা- নেই, সেই অর্থে ছাত্ররাজনীতিও নেই। এসব কারণে দেশে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না। তরুণেরা মত প্রকাশ, তার অনুশীলন ও চর্চার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের সম্মুখে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। বীরত্ব প্রকাশের জন্য সকল সম্ভাবনাময় পথ রুদ্ধ দেখে তারা অন্ধকার পথ বেছে নিয়েছে। তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব বিচ্ছিন্নতা আড্ডাবাজি, চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, পর্নোগ্রাফি এবং অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে যা জাতির জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। বিগত বছর উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটিয়েছে। দৃশ্যমান পদ্মা সেতু এবং রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আগামী নির্বাচনকে উপলক্ষ করে সংলাপের একটি শুভ সূচনা করেছেন- যা জাতিকে আশান্বিত করেছে। এই সংলাপ কতটুকু বাস্তবায়িত হবে-নাকি একেবারেই হবে না- সে বিষয়টি দেখার জন্য জাতি অপেক্ষা করছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে দেশে গণতন্ত্রের যে শুভ আগমন ঘটেছিল। এরকম একটি ঘটনা দেশে ঘটতে পারে। তবে প্রকৃত গণতন্ত্র আসলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় টেকসই হয়। আমরা দূর থেকে যে যাই বলি না কেন রাজনীতি গণতন্ত্র ছাড়া অচল। রাজনীতিতে ভালো কিছু হতেই হবে। রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরে আসলে দেশটাও বিপদমুক্ত হবে। গণতন্ত্রের ইতিহাস তাই বলে। জঙ্গিবাদের বিস্তার ওইসব দেশেই সম্প্রসারিত হয়েছে যেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসন অনুপস্থিত। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে জঙ্গিবাদের অভায়ারণ্যে পরিণত হওয়ার নেপথ্য কারণ গণতন্ত্রহীন সমাজ কাঠামো।
আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের একমাস পরই দেশব্যাপী কয়েক ধাপে ৪৭১টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন শুরু করে। এরপর ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালের শেষের দিকে ২৩৪টি পৌরসভার ভোট সম্পন্ন হয়। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় ধাপে প্রায় ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদে ভোট গ্রহণ হয়। ২০১৬ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ও ৬১টি জেলা পরিষদের নির্বাচন। উপজেলা পরিষদের প্রথম দুই পর্ব এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাদ দিলে বাকি সব নির্বাচনে জাল ভোটের মহোৎসব পরিলক্ষিত হয়। জবরদস্তি, সংঘাত, প্রাণহানি ও শত শত আহত মানুষের আহাজারির ঘটনা ঘটে। বিপুল সংখ্যায় ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের স্টাইলে সরকার দলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ড. তোফায়েল আহমদ ও সুজনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের অভিমত ছিলÑ এফতরফা এসব নির্বাচনে সহিংসতার প্রবণতা নজিরবিহীন। এক কথায় স্থানীয় সরকারও এখন আওয়ামী লীগের কবজায়। এখন শুধু কুমিল্লা সিটি করর্পোরেশন নির্বাচন বাকি আছে। নির্বাচন কমিশন বার্তাকক্ষ থেকে এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধান রির্পোটে দেখা গেছেÑ স্থানীয় সরকারের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৭৫ শতাংশ শীর্ষ পদ এখন আওয়ামী লীগের দখলে। এর সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী যোগ করলে দেখা যায় প্রায় ৮৩ শতাংশ শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের একক নিয়ন্ত্রণে। কাউন্সিলর, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্য পদেও আওয়ামী লীগেরই একক প্রাধান্য ছিল। অন্যদিকে এই ৫ স্তরের ভোটে বিএনপির মাত্র ১১ শতাংশের কম নেতা শীর্ষ পদে বসতে পেরেছেন। এদের মধ্যে অনেক জনপ্রতিনিধি নাশকতার মামলায় বহিষ্কার হয়ে কারাগারে অবস্থান নিয়েছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যে বিতর্কিত এবং পুরোপুরি সরকার সমর্থিত তা উপরে বর্ণিত চিত্রই প্রমাণ করে। ’৭১-এর পর যত নির্বাচন হয়েছে-সেইসব নির্বাচনে এতো ব্যাপক সহিংসতা এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। সেই অর্থে রকিবউদ্দিনের নির্বাচন কমিশন ইতিহাসে একটি ফলক অধ্যায় হিসেবে ইতিমধ্যেই স্থান করে নিয়েছে। উল্লেখ্য যে, আ’লীগ মনোনীত ২০৭ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন।
৩০ ডিসেম্বর ২০১৬ একটি জাতীয় দৈনিকে সুজনের প্রধান নির্বাহী বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরেই এখন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ আধিপত্য দৃশ্যমান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের শুরু থেকে আওয়ামী লীগের মধ্যে বৈধতার সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের উদ্দেশে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। শুধু ব্যতিক্রম নারায়ণগঞ্জ আর উপজেলা পরিষদের প্রথম দুই ধাপে কিছু অংশ বাদ দিয়ে অন্যসব নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেক বিকল্পের মধ্য থেকে একজনকে উপযুক্ত হিসেবে বেছে নেয়া। সেটা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনে যেমন ঘাটতি ছিল তেমনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ঘাটতি প্রতীয়মান হয়। জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়েছে একতরফা। গণতন্ত্র এখানে মৃত বলা যায়।
২০১৬ সালে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল ভারতীয় চ্যানেলের আগ্রাসন এবং বিজ্ঞাপন বাবদ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সংবাদ। গত ৩ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের হেড লাইন ছিল-প্রতি বছরে ৪ শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে বিদেশে চ্যানেল কর্মকর্তাদের পকেটে। ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে এক সপ্তাহে নয়জন নিখোঁজ বা গুম হয়। ২৯ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর এই সাতদিনে তারা নিখোঁজ হয়। ১ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানী থেকে এক সঙ্গে চার তরুণ নিখোঁজ হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম ৯ দিনে বন্ধুক যুদ্ধে নিহত হয় ১৬ জন। দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- চলছেই যা মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। রাজধানী থেকে আবারও হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ। নিখোঁজ না গুম কেউ জানে না। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষের খবর আসছে। ছেলে-সন্তানহারা মা-বাবার কান্নায় প্রতিবেশীরাও কাঁদছেন। ২০১৬ সালে নিখোঁজ ও গুমের পরিসংখ্যান দীর্ঘ। খুনের সংখ্যাও জ্যামেতিক পদ্ধতিতে রূপ নিয়েছে। ৬-১২-২০১৬ পত্রিকায় নিউজ-নাটোরে নিখোঁজ ৩ যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ মিললো দিনে-দুপুরে। ৩০ ডিসেম্বর টিভি চ্যানেলের লিড নিউজ ছিল ‘অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশে এসব কী হচ্ছে’। দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর ২০১৬ সালে অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
এবার আসুন, দেশের সর্ববৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং খাতের দিকে দৃষ্টি দেই। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয় এ ঘটনার দায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন তৎকালীন গর্ভনর আতিউর রহমান। বরখাস্ত করা হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকেও। চুরি হওয়া টাকার কিছু ফেরত পাওয়া গেলে বাকি রয়েছে অধিকাংশই, তা ফেরত পাওয়া নিয়ে অগ্রগতি স্পষ্ট নয়। এ ঘটনার তদন্ত কমিটির রিপোর্টও আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশ দায়ী করছে বিদেশিদের আর বিদেশিরা বাংলাদেশের ওপর দায় চাপাচ্ছে। বাংলাদেশে রিজার্ভ চুরির ঘটনা এখন সারা বিশ্বের বড় সাইবার ক্রাইম হিসাবে পরিচিত। ২৯ জুন দুর্নীতির দায়ে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদকে অপসারণ এবং ডিএমডি মিজানুর রহমান আটক করা হয়। ১৬ আগস্ট রাষ্ট্র মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের নতুন এমডি নিয়োগ। ৬ ফেব্রুয়ারি তিন ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকগুলো হলোÑ ইস্টার্ন, সিটি ও ইউসিবিএলের চার এটিএম বুথে বিশেষ ডিভাইস দিয়ে কার্ড জালিয়াতি করা হয়। পরে নতুন কার্ড তৈরি করে গ্রাহকের হিসাব থেকে টাকা তুলে নেয় বিদেশিরা। এর সাথে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রবাসী আয় নি¤œমুখী ২০১৬ সালে ২০১৫ সালের থেকে আয় কমেছে ১৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০১৬ সাল এনবিআরের জন্য ভালো ছিল। ১১ মাসে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। যা ২০১৫ সালের চেয়ে বেশি ছিল। মূল্যস্ফীতি এ সময় দেশের মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। ২০১৬ সালে কর্মসংস্থানের জন্য খুব ভালো বছর ছিল না। কারণ বিদেশে গিয়ে কায়িক পরিশ্রমের বিনিময়ে অল্প মজুরি আয় আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয় এ কারণে রেমিন্ট্যাসে ভাটার গতি লক্ষ্য করা গেছে। দেশে কর্মসংস্থান বাড়েনি। ২০১৬ সালে মাত্র ৭ লাখ লোক বিদেশে গেছে নি¤œ বেতনে। বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য দেশে বাংলাদেশিদের কম বেতন দেওয়া হয়। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে এ তথ্য পাওয়া যায়।
২০১৬ সালে আলোচনায় ছিল বিচার বিভাগ দুই মন্ত্রীকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দ-; তারপরও মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তেফা দেননি দুই মন্ত্রী। ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল। প্রধান বিচারপতির দেয়া একাধিক বক্তব্য, বিবৃতে অবসরে গিয়ে রায় লেখা নিয়ে প্রচ- বিতর্ক হয়। পক্ষে-বিপক্ষে এ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে সর্বত্র। সরকারের একাধিক মন্ত্রীও বক্তব্য প্রদান করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে তোলপার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার বিষয়ে আপিল বিভাগের নীতিমালা, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাভোগ এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় আলোচনায় ফিরে আসে উচ্চ আদালত।
২০১৬ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৫৭ জন নিহত হয়, ২ হাজার ৪২৯ জন নির্মমভাবে খুন হয়। ২০১৬ সালের শেষ দিন শনিবার ৩১ ডিসেম্বর ঘরে ঢুকে সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার কেন্দ্রস্থল ছিল নিজ বাড়ি গাইবান্দার সুন্দরগঞ্জে। এ ঘটনা ঘটার দিনই খুলনায় আ.লীগ নেতাকে গুলি করতে গিয়ে প্রাণ হারালো পথচারী এক নারী।
২০১৬ সালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, সেই অনুপাতে বিনিয়োগ পড়েনি। বেসরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে কিন্তু কমেছে সরকারি বিনিয়োগ। বিনিয়োগ উদ্যোক্তাদের আগ্রহ কম ভারী শিল্পে। তারা সস্তা আয় যেখানে বেশি সেখানেই বিনিয়োগ করছে ফলে বেকারত্ব হ্রাস না পেয়ে বেড়েছে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স (এবিবি) চেয়ারম্যান আনিস এ খান পত্রিকাকে বলেছেন, ২০১৬ সালে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগ সেভাবে বাড়েনি। এ সময় অনেক বড় প্রকল্প স্বাক্ষরিত হয়েছে বাস্তবায়ন কেমন হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০১৭ সাল পর্যন্ত।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।