পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে প্রথমবারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়া একটি রোহিঙ্গা নির্যাতনের ভিডিওকে আমলে নিয়েছে মিয়ানমারের সরকার। ভিডিওটি করেছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের এক কর্মকর্তা। এর আগে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে রাখাইন রাজ্যে তাদের উপর নির্যাতনের চিত্র প্রকাশ করলেও মিয়ানমার সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। আলোচ্য ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশ কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের মারধর করছে। এদিকে প্রকাশিত ভিডিও’র জের ধরে কয়েকজন পুলিশকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। গত সোমবার মিয়ানমার সরকারের দেয়া এক বিবৃতির বরাতে আটকের খবরটি দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এদের মধ্যে চার পুলিশ কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করেছে মিয়ানমার সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভিডিওটিতে যাদের প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা হয়েছে তাদের আটক করা হয়েছে। অভিযানের সময় যারা গ্রামবাসীকে নির্যাতন করেছে তাদের ধরতে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হচ্ছে। এর আগে রাখাইন প্রদেশের কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে এক বার্তায় বলা হয়েছে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আইন ভঙ্গ করেছে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিজিপি সদস্যরা রোহিঙ্গাদের মারতে মারতে একটি খোলা জায়গায় এনে জড়ো করেছে। সেখানে অন্তত ৬০ জন রোহিঙ্গাকে মাথায় হাত তুলে এবং সামনে পা ছড়িয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এতে আরো দেখা যায়, বিজিপি সদস্যরা আটক করে রোহিঙ্গাদের ইচ্ছামতো পেটাচ্ছে এবং বুকে-মুখে ঘুষি, লাথি দিচ্ছে। বিবিসি জানিয়েছে, এক বিবৃতিতে ভিডিওতে দেখানো নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। তারা জানিয়েছে, নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষ ও তার দু’দিন পরেই এ ঘটনা ঘটেছে। এর আগে রাখাইনে সেনাবাহিনী আইন মেনে কাজ করছে বলে দাবি করলেও নির্যাতনের নতুন ভিডিও’র প্রেক্ষাপটে পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে বর্বর ও অমানুষিক নির্যাতন পরিচালনা করা হয়েছে তা অতীতের যেকোন বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার আধুনিক যুগে এধরনের নির্মমতা চালাতে পারে তা বোধকরি সচক্ষে না দেখলে কারোরই বিশ্বাস হতো না। এই বর্বরতা তুলে ধরতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এখনকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের নির্বাহী সদস্য লিন বলেছেন, রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মিয়ানমার সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা চরম হিংস্রতা দেখিয়েছে। দেশটিকে রোহিঙ্গাদের জন্য দোজখে পরিণত করেছে তারা। প্রকৃত বিবেচনায় সেখানে সেনা শাসন থাকার সময় থেকেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর নৃশংসতা চলছিল। এর ধারাবাহিকতাতেই সেখানকার নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার বঞ্চিত করার সূত্র ধরে গত নভেম্বরে পরিচালিত হয় মানবতার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপরাধ। মালয়েশিয়াভিত্তিক রোহিঙ্গাভিশন টিভি জানিয়েছে, নভেম্বরের শুরুতে রাখাইনের রাতেডং এলাকায় কুয়েতানকাউক গ্রামে আলোচ্য ভিডিও’র ঘটনাটি ঘটে। গ্রামটি স্থানীয়ভাবে ডাউনেসে ফারা নামে পরিচিত। ওই এলাকায় ৬ নভেম্বর বিজিপি ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান চলে। ৫ নভেম্বর ভিডিওটি করেন এক বিজিপি সদস্য। পরে ২৯ ডিসেম্বর এই ভিডিওচিত্র প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপে প্রচার করা হয়। এক পর্যায়ে ভিডিওটি ফেসবুকে পোস্ট করা হলে তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের কোন কোন মহলে ব্যাপক বিরোধিতা রয়েছে। এরমধ্যে সুচির নিজের দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিরও অনেকে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক প্রবল চাপের মুখে গত বছর সুচি বিষয়টি সুরাহার জন্য সময় চান। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মৌলিক অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে মিয়ানমার। ২০১২ সালে ভয়াবহ দাঙ্গায় ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন। এরপর থেকে দেশটিতে নিয়মিত বিরতিতে রোহিঙ্গাদের উপর হত্যা-নির্যাতন চলছে। বিষয়টি নিয়ে সুচির নীরবতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালেচনার ঝড় তুলে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী পুলিশ ও একশ্রেণীর বৌদ্ধদের পরিচালিত বীভৎসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের শাসক তথা সুচির উপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই সমাধানের জন্য চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে। কারণ, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির জন্য বিশ্বের বহু দেশে রোহিঙ্গারা এক ধরনের যাযাবর জীবন যাপন করছে।
অনেক দিন থেকেই মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানরা কেবল তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণেই নির্যাতিত হচ্ছেন। এটি জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার সনদের পরিপন্থী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যাকা-ের নিন্দা করেছেন। বাস্তবত, এ পর্যন্ত পরিস্থিতির কোন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতনের যে সাময়িক স্বীকৃতি মিয়ানমার সরকার দিয়েছে তা প্রকৃত ঘটনার প্রেক্ষিতে সামান্যই। একজন বিজিপি সদস্যের করা ভিডিওকে দেশটির সরকার আমলে নিয়েছে, তার অর্থ হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা তারা চেপে যেতে চাচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যেভাবেই হোক যে কারণেই হোক, গত নভেম্বরের ঘটনা তদন্ত ও দোষীদের খুঁজে বের করতে তদন্তের কথা স্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। এটি ইতিবাচক। অবশ্যই তদন্ত হতে হবে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। সে কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাকে এই তদন্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ঘটনার সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর কোন কোন সদস্যের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি রয়েছে বিধায় ও পুরো তদন্ত যাতে বিশ্বাসযোগ্য হয়, সেজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখেই। কোন দায়সারা তদন্ত বা বিচার উদ্ভূত পরিস্থিতির কোন মীমাংসা নয়। সেখানে সংঘটিত মুসলিম নির্যাতনে সকল ঘটনা তদন্তের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা যাতে সে দেশে ফিরে যেতে পারে তার সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধান করতে হবে। এটা সকলেই মনে রাখতে হবে, বহুল আলোচিত এ তদন্ত ও বিচার যেন হাস্যকর না হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।