Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা

| প্রকাশের সময় : ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বিলম্বে হলেও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী, মানবহিতৈষীসহ সাবেক সরকার প্রধান ও বিশিষ্টজনরা সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ ১৩ নোবেল বিজয়ী এবং আরও ১০ জন মানবদরদী ব্যক্তি। তারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইউএনএসসি’র কাছে এক খোলা চিঠিতে অবিলম্বে রোহিঙ্গা সমস্যা এবং মিয়ানমার সরকার কর্তৃক তাদের উপর পরিচালিত হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, বিতাড়নসহ নিষ্ঠুর কর্মকা- পরিচালনা বন্ধে এজেন্ডা আনতে বলেছেন। পাশাপাশি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে জরুরী ভিত্তিতে মিয়ানমার সফরে যেতে বলেছেন। তার মেয়াদকালে সম্ভব না হলে জানুয়ারীতে আসা নতুন সেক্রেটারির প্রথম কাজ হিসেবে মিয়ানমার সফরে যেতে বলেছেন। চিঠিতে তারা মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে রুয়ান্ডা, দারফুর, বসনিয়া এবং কসোভোর গণহত্যার শামিল বলে উল্লেখ করেন। তারা জাতিসংঘকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, যত ধরনের পন্থা রয়েছে সব অবলম্বন করে মিয়ানমারের সরকারকে এ হত্যাযজ্ঞ বন্ধে উদ্যোগ নিতে বাধ্য করতে হবে। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের সমান নাগরিকত্ব দেয়াসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অং সান সুচিকে বারবার আহ্বান জানিয়েও কোনো ধরনের সাড়া পাননি। তারা অং সান সুচিকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দায়ী করেন। এদিকে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বলেছে। এজন্য বাংলাদেশ মিয়ানমার সরকারের সাথে আলোচনা করতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে।
বিগত প্রায় দুই মাস ধরে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর যে নিপীড়ন, নির্যাতন ও গণহত্যা পরিচালিত হচ্ছে, তা বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। শত শত রোহিঙ্গাকে গুলি করে, হাত-পা কেটে, আগুনে ছুঁড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা কোনো সভ্য জগতের কাজ হতে পারে না। মিয়ানমার সরকারের এ আচরণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড সোচ্চার হলেও বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো অনেকটাই নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘসহ এসব রাষ্ট্র কেবল মুখে মুখে ‘এ কাজ ঠিক হচ্ছে না’ বলে এমন নির্বিষ বক্তব্য দিয়েই দায় সারছে। এমনকি আরব বিশ্বের দেশগুলোও মুখে যেন কুলুপ এঁটে বসে আছে। যেখানে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিশাল সমাবেশ করে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ও গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, ইন্দোনেশিয়ার সরকারও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে, সেখানে আর কোনো দেশের কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা যায়নি। সর্বশেষ ওআইসি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিবাদের প্রতি সমর্থন দিয়ে চিঠি লিখে তার দায় পালন করেছে। কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো এবং সহায়তা করার লক্ষ্যে চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সফর করেছে। জাতিসংঘের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটিকে রাখাইনে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের টুঁ শব্দ করেনি। এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নোবেল জয়ী ১৩ জনসহ ২৩ মানবহিতৈষী ব্যক্তি জাতিসংঘকে উদ্যোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের এ আহ্বান এবং বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবেই অভিনন্দনযোগ্য এবং কার্যকর উদ্যোগ বলে আমরা মনে করি। শান্তিতে নোবেল জয়ী এসব ব্যক্তিত্ব আরেক নোবেল জয়ী অং সান সুচির তীব্র সমালোচনা করে তাকে গণহত্যা পরিচালনা করার জন্য দায়ী করেছেন। এর আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বক্তব্যে অং সান সুচি ‘অসহ্য’ বলে বিরক্ত প্রকাশ করেন। তার এ ধরনের প্রতিক্রিয়ায় বুঝতে বাকি থাকে না, তিনি কতটা ‘নিষ্ঠুর’ হতে পারেন। তিনি যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাকে তিনি মূল্যহীন করে তুলেছেন। এ কারণে তার নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহারের জন্য বিশ্বব্যাপী দাবিও উঠে। দুঃখের বিষয়, এতদসত্ত্বেও অং সান সুচির মানবতাবোধ জাগ্রত হওয়া দূরে থাক, নিষ্ঠুরতা ছাড়া তার আর কোনো ধরনের বোধোদয় হয়নি। আরও পরিতাপের বিষয়, বিশ্বের যেখানেই মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, নিধনযজ্ঞ চলছে, সেখানেই জাতিসংঘসহ বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো অনেকটা নীরব ভূমিকা পালন করে চলেছে। শান্তি আলোচনার নামে মুসলমান নিধনকে প্রলম্বিত করে চলেছে। নোবেল জয়ী ১৩ জনসহ ২৩ মানবদরদী তাদের চিঠিতে বলেছেন, এ মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় জাতি রোহিঙ্গাদের নির্মূল করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার। অথচ মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা আদিবাসী এবং তারা শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। শুধু মুসলমান হওয়ায়, মিয়ানমার সরকার তাদের হত্যা ও উচ্ছেদের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দিতে চাইছে।
রোহিঙ্গা নির্মূলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলের মৌখিক কোনো আহ্বানকেই মিয়ানমার সরকার আমলে নিচ্ছে না। তার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, সে রোহিঙ্গা নির্মূলে বদ্ধপরিকর। কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করায়, সে এখন নির্যাতনের ধরন বদলে নিধন অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর পরিবর্তে রাখাইনের উগ্র তরুণদের নিয়ে নাডালা নামের বেসরকারি বাহিনী গঠন করে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চালাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে নোবেল জয়ী ও বিশ্বের বিশিষ্টজনরা জাতিসংঘের কাছে যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে জাতিসংঘসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর দ্রুত সাড়া দেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। বলা বাহুল্য, রোহিঙ্গাদের উপর যে আক্রমণ চলছে, তা কোনো দুর্যোগসৃষ্ট নয়, মানবসৃষ্ট। ইচ্ছা করলেই তা বন্ধ করা যায়। এখন সময় এসেছে এ সদিচ্ছা দেখানোর। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘকে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সরকারের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হবে। নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত কমিটি গঠন করে আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন