পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করা নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা সরকার সচেতনভাবেই করছে বলে মনে করেন দলটির অনেক নেতা। তারা বলছেন, এর পেছনে আন্তর্জাতিক চাপসহ নানা কারণ থাকতে পারে। সরকার বলছে, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে যে বিতর্ক, তার পেছনে সরকারের কোন দূরভিসন্ধি নেই। আর রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে দাবি রয়েছে, তা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্য দিকে সরাতেই এমন বিতর্ক শুরু করতে পারে আওয়ামী লীগ।
এনিয়ে সরকারের বেশ ক’জন মন্ত্রী-নেতা নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে শুরু হয়েছে মূল বিতর্ক। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। একই মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তবে কিছুটা ভিন্ন মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই খালেদা জিয়ার। আর আইনমন্ত্রী বলেছেন, রাজনীতি করতে কোনো বাধা না থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বিএনপির চেয়ারপারসন।
সরকারের একাধিক মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের কারণেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনের বছরে বিএনপিপ্রধানের ব্যাপারে মন্ত্রীরা কেন এ ধরনের মন্তব্য করছেন? বিএনপিকে নির্বাচনে আনা এবং দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ওই নির্বাচনের বাইরে রাখার একটি ছক নিয়ে এগোচ্ছে কি সরকার? কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই ছকটির একটি গুটি ছোঁড়া হয়েছে আইনমন্ত্রীকে দিয়ে। এর ফল এখনো বাকি। তবে নগদে রাজনীতির আলোচনার বাজার জমেছে। বিএনপি নেতৃত্বের একটি অংশ সরকারের খেলাটি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তাই তারা স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া না দিয়ে আশপাশে কথা বলছেন। সরকার কোন পথে কতোটুকু আগে বাড়ে তা পর্যবেক্ষণ করছে এ অংশটি। দলটির থিঙ্কট্যাংকও এ ব্যাপারে বেশ সাবধানী।
আওয়ামী লীগ এক ঢিলে কয়েক পাখি মারতে চায়। এর আগে বলেছে, খালেদা জিয়া আর রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা দিয়ে জামিন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায়। এখন কথা ঘুরিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ প্রমাণ করতে চাইছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা রাজনীতি করার জন্য উপযুক্ত নয়। তাই বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে ক্ষীণ আশা আছে, খালেদা জিয়া দেশ ও দলের দায়িত্ব নেবে, সেটা নিঃশেষ করতে চাইছে। তাই আর বাহানা না করে বিএনপি নেতাকর্মীরা যেন নির্বাচনে চলে আসে। এর রহস্যও পরিষ্কার। আন্দোলনের কোনো পর্যায়ে খালেদা জিয়া অ্যাকটিভ হয়ে যেতে পারেন বলে আতঙ্ক আছে সরকারের ভেতরেও। তখন সরকারের তা সামলানো অসাধ্য হবে। তাই আগে ভাগেই একটা টোপ দিয়ে বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে চায় সরকার। সরকারের তখন ওই নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক বলে চালিয়ে দেয়া সহজ হবে।
বিএনপির হার্ডকোরের নেতারা মনে করেন, সরকারের খালেদা জিয়াকে নিয়ে কোনো মহানুভবতা নেই, আছে শুধু ভয়। সেই ভয় থেকেই এতো ছক ও পরিকল্পনা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তা বুঝতে পেরে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও মাত্রা দিতে এবার দলের নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদেরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত দলের সমর্থনে বিজয়ী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় স্থান পেয়েছে চার সহস্রাধিক নেতাকর্মী। এর মধ্যে প্রথম ধাপে প্রায় আড়াই হাজার সাবেক ও বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ-ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এরইমধ্যে তাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। প্রস্তাবিত রুটিন অনুযায়ী, ১৬ মার্চ নাগাদ বিভাগভিত্তিক এসব বৈঠক হওয়ার কথা। প্রতিটি বৈঠকে ২৫০ জন জনপ্রতিনিধির সঙ্গে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি মতবিনিময় করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর উদ্দেশ্য রাগ-ক্ষোভ এবং অভিমানে দীর্ঘদিন ধরে দূরে বা নিষ্ক্রিয় থাকা নেতাকর্মীদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসা।
দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা থাকলেও বিএনপি নির্বাচনী প্রস্তুতিতে সময় দিচ্ছে। বিএনপি সমর্থিত কিছু জনপ্রতিনিধিকে নানা প্রলোভনে ফেলে কিংবা তাদের রাগ-ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে দলের ব্যানারে ভিন্ন কিছু করতে পারে, সেই শঙ্কাও বাদ দিচ্ছেন না বিএনপির হাইকমান্ডের নেতারা।
বিভিন্ন সময় বহিষ্কৃত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে দলে অ্যাকটিভ করার তালিকাও চূড়ান্ত। এ নিয়ে একটি টিমকে মাঠে নামানো হয়েছে। তাদের দাফতরিক কাজ ও নোটে এরইমধ্যে তৃণমূলের বেশ কয়েকজনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারও করা হয়েছে। তবে বাকি রয়ে গেছে অনেক। তাদের ব্যাপারেও শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসবে।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলার মধ্যে দুটিতে সাজা হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তার পাঁচ বছরের কারাদ- হয়। সেদিনই কারাবন্দি হন তিনি। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর উচ্চ আদালত সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। তার আগে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি নেত্রীর সাত বছরের সাজা হয়। আইনি লড়াইয়ে খালেদা জিয়া মুক্ত না হওয়ায় পরে পরিবারের আবেদনে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে শর্ত সাপেক্ষে সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য তাকে মুক্তি দেয়। পরের দিন তিনি কারামুক্ত হয়ে গুলশানের ভাড়া বাসা ফিরোজায় ওঠেন। সেই থেকে আছেন এখনো। মাঝেমধ্যে প্রজ্ঞাপন দিয়ে জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়।
দীর্ঘ অসুস্থতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতায় খালেদা জিয়া বর্তমানে রাজনীতির মাঠের বাইরে হলেও নিষ্ক্রিয় নন। তিনি বাসা থেকে বের হন না মানে শুয়ে-বসে থাকেন ঘটনা মোটেই তা নয়। নিয়মিত কথা বলেন বিভিন্ন জনের সাথে। কেউ কেউ তার সঙ্গে দেখা করতেও যান। সব খবর বাইরে আসে না। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তৃণমূল পর্যায়েও কথা বলছেন নিয়মিত।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে শেষতক কী হবে? যে ধারায় খালেদা জিয়ার শাস্তি স্থগিত করা হয়েছে, সেই ধারা শর্তযুক্ত হতে পারে। আবার শর্তমুক্তও হতে পারে। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে সরকার দুটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে, যথাক্রমে তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা করাবেন এবং বিদেশে যেতে পারবেন না। বিএনপির নেতারা তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়ে সরকারের কাছে বারবার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন করলেও সরকার তা গ্রাহ্য করেনি। সরকার চায় তার আজ্ঞাবহ জাতীয় পার্টি, জাসদ ধরনের কিছু দলের আজ্ঞাবহতা।
গত বছরের অক্টোবর থেকে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শুরু হওয়ার পর দলটির ভেতর চাঙা ভাব দেখা দিয়েছিল। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশের আগেই আওয়ামী লীগ সাফল্যের সঙ্গেই তা মিইয়ে দিতে পেরেছে। দলের মহাসচিবকে মাঝে মাসখানেক জেল খেটে আসতে হলো। এখন পায়ে হেঁটে দলটি ‘নীরব প্রতিবাদের’ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দলীয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা নয়, বরং তার উন্নত চিকিৎসার জন্য নিঃশর্ত মুক্তি চায় বিএনপি। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলেছেন, শর্তযুক্ত মুক্তি দিয়ে সরকার কার্যত বেগম জিয়াকে বন্দি করে রেখেছে। তিনি আসলে স্বাধীন নন। তার মুক্তজীবন ও সম্পূর্ণ সুস্থতাই দলের এখন মূল অগ্রাধিকার। বিএনপির নেতারা মনে করেন, বিএনপির দলীয় রাজনীতিতে এই মুহূর্তে কোনো শূন্যতা নেই। বেগম খালেদা জিয়া নিজেই ২০০৯ সালের কাউন্সিলে তারেক রহমানকে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানের পদে নির্বাচিত করে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করে রেখেছিলেন, যিনি এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বেই সুশৃঙ্খলভাবে চলছে বিএনপি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।