পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের চারপাশের মাটি, পানি, বায়ু, সকল কিছুই পরিবেশের অন্তভুর্ক্ত। দুর্যোগ বলা হয় স্বাভাবিক নিয়মের বাইরের কিছু ঘটনা। পরিবেশের বিঘ্নতার সাথে রয়েছে দুর্যোগের সম্পর্ক। পরিবেশকে তার নিয়মে চলতে না দিলে দুর্যোগের আগমন অবশ্যম্ভাবী। দূুর্যাগের ঘনঘটা এবং ধ্বংসের লীলা জানার পর পরিবেশকে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করা মানবজাতির জন্য সাধারণ একটি বিষয়। দুর্যোগ প্রধানত দুইটি। ১. মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ। পরিবেশের প্রতি মানুষের নির্বিচার আচরণের কারণে পরিবেশ ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। যাকে নাম দেয়া হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ জন্ম দেয় তথাকথিত মানবসৃষ্ট দুর্যোগের।
নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশে হাজারও নদী বহমান। কোনটা উত্তাল,কোনটা মৃতপ্রায়। মানব সভ্যতার শুরু এই নদীকে ঘিরেই। পৃথিবীর হাজারো সভ্যতার মূল খুঁজতে গেলে চলে আসবে নদীভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা। বাণিজ্য থেকে সাধারণ জীবন সকল কিছুই গড়ে উঠে নদীকে ঘিরে। সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সকল মানুষ নদীর ওপর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভর করে বেঁচে আছে। কিন্তু নীরব ধারায় বহমান নদী কখনো উত্তাল হয়ে দু’পাড় গ্রাস করে। মাটি দূষণ, বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বৃদ্ধি, নদীর পাড়ে গাছ কমে যাওয়া, পানি দূষণ, নিয়মিত নদী খনন না করা, নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করাসহ নানা কারণে প্রায় সকল নদী প্রতিবছরই ভাঙনের শিকার হয়। এই নদীর ভাঙা-গড়ার মাঝেই সৃষ্টি হয় নতুন স্বপ্ন , নতুন আশা। তবে সেই আশা সবসময় বাস্তবে পরিণত হয় না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত চার দশকে প্রায় এক লাখ হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের এই হিসাবকে নিছক ভূমির হিসাবে ধরলে ভুল হবে, কারণ নদীভাঙন মানে একটি পরিবারের ধ্বংস, হাজারও স্বপ্নের মৃত্যু। বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি আল মাহমুদ তার ‘চোখ যখন অতীতাশ্রায়ী হয়’ কবিতায় নদীভাঙনের জর্জরিত একটি পরিবারের গল্প তুলে ধরেছেন। কবিতাটিতে এক কিশোর তার মায়ের কান্না দেখে বলেছিল, ‘কাঁদলেন এমনভাবে যে অভিযোগহীন এমন রোদন ধ্বনি বহুকাল শুনিনি আমি।’
প্রকৃতপক্ষেই নদীভাঙনে সহায় সম্বলহীন অসহায় মানুষগুলো কখনো কারও কাছে অভিযোগ করতে পারে না। এই কান্নার জন্য কারও কাছে অভিযোগ করা যায় না। পরোক্ষভাবে কাউকে দায়ীও করা যায় না। নদী সামনে যা পায় তাই ভাঙতে শুরু করে। বাজার, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, কোনো কিছুতেই তার ধরা-বাধা নিয়ম নেই। প্রতি বছরই এই নদীভাঙনের ফলে প্রায় এক লাখ লোক ভূমিহীন হয়। শত একর জমির মালিকও নিমিষেই নিঃস্বের খাতায় নাম লেখায়। গৃহিণীর সামনে তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসার যখন চোখের পলকেই শেষ হয় যায়, তখন সেই গৃহিণীর বুক ভাঙা হাহাকার শোনার কেউ থাকে না। আল্লাহকে ডাকার জন্য সারাদিন পাঁচবার যেই ঘরে আসা যাওয়া হতো, যখন দেখা যায় সেই ঘরটি আর নাই তখনও নীরবে কান্না ছাড়া কিছুই করার থাকে না। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির চোখে তখন ধরা পড়ে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের চিত্র। যেই স্বপ্নগুলো এতদিন বাসা বেঁধেছিল তার হঠাৎ ধ্বংস দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে উদাস দৃষ্টি দেয়া চোখে তখন পানিও থাকে না। তারপর মানুষ আবারো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য এদের মধ্যে বেশিরভাগই নতুন গন্তব্যের জন্য শহরের পথ ধরে। শহরের লাল নীল আলোতে রাতের আঁধার দূর হলেও এই অসহায়দের শহর দেখতে পারে না। অসহায় মানুষগুলো প্রচণ্ড অন্ধকারে আলোর নাগাল পায় না। শহরের জীবন অত্যন্ত কঠিন। শহরে আসা পরিবারটির প্রথমেই আশ্রয় হয় কোনো রেলস্টেশনে বা ফ্লাইওভারের নিচে। ভাগ্য সহায় হলে কারও হয়তো বা মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই কোন এক বস্তিতে হয়ে যায়। থাকার পর প্রয়োজন দুবেলার দু মুঠো খাবার। কিন্তু যে শহরে এক গ্লাস পানি খেতেও টাকা লাগে, সেই শহরে পেট ভরে খাওয়া আর ঘরে বসে চাঁদ দেখা তো এক কথা নয়। এখন প্রয়োজন কাজ খোঁজা। শহরে কাজ তো সোনার হরিণ সমতুল্য। এই সোনার হরিণের দেখা পাওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু পেট তো সেই অবধি অপেক্ষা করতে চায় না। তাকে প্রতিদিন তিন বেলা খাবার দিতে হয়।
সত্যিকার অর্থেই এই মানুষগুলো যখন বাঁচার জন্য কোনো কাজ খুঁজে পায় না, তখন অজানা পথের দিকে পা বাড়ায়। অসহায় মানুষগুলো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। নদীর বুকে সারাদিন সাঁতার কেটে বেড়ানো দুরন্ত স্বভাবের ছেলেটার হাতে তখন অস্ত্র উঠে যায়। ছোট-খাটো বিষয় দিয়ে অপরাধ জগৎ শুরু হলেও এক সময় তা বিরাট আকার ধারণ করে। প্রমথ চৌধুরীর সেই কথা ব্যধিই সংক্রামকের মতো পুরো সমাজে অপরাধের ডাল পালা গড়ে উঠে। মাদক, রাহাজানি, অপরাধের এক একটি আঁকড়া হয়ে ওঠে এই বস্তিগুলো। মাদকসন্ত্রাসী, পিকেটার হিসেবে এরাই আবার জেলহাজত খাটে। এভাবেই সমাজে অপরাধ প্রবণতা বিস্তার করে। সমাজের শ্রেণী বৈষম্য দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ঘটনা যদি আজ নিত্যকার। সমস্যাগুলো কখনো এভাবে লেখা হতো না, যদি না সেইদিন তাদের ঘর নদীতে নিয়ে না যেত। অর্থাৎ প্রথমেই যদি নদীভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যেত তাহলে এই মানুষ শহরে আসত না, অপরাধও সংগঠিত হতো না। এই ভূমিহীন মানুষগুলো অজ্ঞতার এবং অশিক্ষার ফলেও অন্যায় কাজে নিজেকে সঁপে দেয়। প্রতিবছরই দেশে নদীভাঙনের সময় হাজারও স্বপ্ন ভাঙনের কবলে পড়ে।
এখন সময় এসেছে ভাবার। নদীভাঙন রোধকল্পে টেকসই বেড়িবাধসহ, নদীশাসন, ড্রেজিংসহ সবধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের যত্ন নেয়া সময়ের দাবি। পরিবেশের সাথে বিরূপ আচরণ করলে পরিবেশও বিরূপ আচরণ করবে। এর জন্য শুধু প্রশাসন নয়, আমাদের সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখকঃ ৪র্থ বর্ষ, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।