Inqilab Logo

শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ডায়াবেটিস নীরব মহামারি

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২ মার্চ, ২০২৩, ১২:০২ এএম

পৃথিবীতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা হলো আনুমানিক ১৫ কোটি। বাংলাদেশকে ডায়াবেটিস রোগীর অঘোষিত রাজধানী বলা হয়। বংশগত, জিনগত ও লাইফ স্টাইলের কারণে ইদানিং অবশ্যই এ রোগ মানুষের ঘুম তাড়াচ্ছে। ১ মাসের বাচ্চা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-পৌঢ় পর্যন্ত সবাই এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা যে খাবার খাই তাকে এনার্জিতে পরিণত করার মেটাবলিক অক্ষমতাই ডায়াবেটিসের উৎস, যার ফলে ব্লাড সুগার লেবেল নিয়ন্ত্রণে থাকে না। প্যানক্রিয়াস থেকে নিঃসৃত ইনসুলিন যার প্রধান কাজ রক্তের শর্করাকে দেহের বিভিন্ন কোষে কোষে পৌঁছে দেয়া আর এর কাজ যখনই ব্যাহত হয় তখনই সমস্যার শুরু হয়ে যায়। সোজা কথায় রক্তের শর্করা ব্লাডস্ট্রিম থেকে ব্লাডসেলে যথাযথভাবে পরিবাহিত হতে না পারলেই শরীরে ব্লাড সুগার লেবেল ভারসাম্য হারায়। জেনে রাখা ভালো, ডায়াবেটিস কিন্তু দুই রকমের, টাইপ-১ ডায়াবেটিস এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস। টাইপট-১ ডায়াবেটিসকে জুভেনাইল ডায়াবেটিসও বলা হয়। এ রোগে প্যানক্রিয়াস থেকে ইনস্যুলিন নিঃসরণে সম্পূর্ণ ঘাটতি দেখা যায়। সাধারণত বাচ্চাদের মধ্যে এ প্রকৃতির ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায়। আর টাইপ-২ ডায়াবেটিসে ইনসুলিনের কার্যকলাপ ব্যাহত হয়, ইনসুলিন কম নিঃসরণ হয়। সাধারণত এক্ষেত্রে তেমন কোনও সিম্পটম থাকে না। ফলে ধরা পড়তে দেরি হয়। যাদের ক্রমিক ইনফেকশন বেশি হয় তাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস হবার আশঙ্কা বেশি। এছাড়াও এক্সসারসাইজের অভাব এবং ওবেসিটিও টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার অন্যতম কারণ। আবার ভাইরাল ইনফেকশন এবং অপুষ্টির তীব্রতায় ও প্যানক্রিয়াসের কোষসমূহ ধ্বংস হয়ে গিয়ে ডায়াবেটিসের মতো রোগ চলে আসতে পারে। এগুলোই হল ডায়াবেটিসের রিস্ক ফ্যাক্টর। একনজরে ডায়াবেটিসের লক্ষণ-অতিরিক্ত পানির পিপাসা, যথেষ্ট খাবার খেলেও ওজন কমতে থাকা, দুর্বল ও নিস্তেজ লাগা, ঘনঘন প্র¯্রাব/বাথরুমে যাওয়া, চোখের ঝাপসা দৃষ্টি, শরীরের কোন অংশ কেটে গেলে শুকাতে দেরী হওয়া, পায়ে ব্যথা বা একটু হাঁটলেই ব্যথা বা খিছে ধরা, জিভ শুকিয়ে যাওয়া, ত্বকে ইস্ট ইনফেকশন, চুলকানি।

ডায়াবেটিস হওয়ার আরও কিছু কারণ হলো, আরাম আয়েশী জীবন-যাপন, কাজ কম খাবার খান বেশি, একদম না হাঁটা, লিফট ব্যবহারের অভ্যাস, কাজের চাপ, পারিবারিক অশান্তি, কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, দীর্ঘদিন অসুখে ভোগাসহ নানা কারণে স্ট্রেস বাড়ে। এসব কারণে ইনসুলিনের ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং রক্তে সুগারের পরিমাণ বেড়ে যায়। যারা অতিরিক্ত ওজনের অধিকারি (ওবেসিটি) অর্থাৎ কোমর ও পেটের অতিরিক্ত মেদ ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেয়। সঙ্গে হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, কার্ডিও ভাসকুলার কমপ্লিকেশন দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস-ইনসুলিন দিয়ে ব্লাড সুগার কন্ট্রোল রাখতে পারলে নর্মাল প্রেগনেন্সিতে কোনো সমস্যা নেই। তবে কনসিভ করার আগেই ইনসুলিন নেয়া শুরু করলে ভালো। গর্ভস্থ ভ্রুণ ও মায়ের শরীরের জন্য প্রেগনেন্সির সময় ইনসুলিন নেয়া জরুরি। তবে তা হতে হবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে।

ইদানিং বিশেষ করে শহুরে বাচ্চাদের মধ্যে স্থূলতা ও ওভারওয়েটের আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। তাছাড়া স্কুলে পড়াশুনার ক্রমাগত চাপ, সারাক্ষণ বসেবসে টিভি/কম্পিউটার দেখা, ফাস্টফুড/জাঙ্কফুডে অভ্যস্ত হওয়া, শারীরিক পরিশ্রম না করা, সাতার কাটা, সাইকেল চালানো, ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, নাচ, দৌড়ানো ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার কারণে এ রোগের হার বেড়ে চলেছে। বয়স ৪০ এর বেশি হলে, পরিবারে ডায়াবেটিসের ইতিহাস থাকলে, ওবিস হলে, পুরুষের ওয়েস্ট লাইন ৪০ ইঞ্চি ও মহিলাদের ওয়েস্ট লাইন ৩৫ ইঞ্চি এর বেশি হলেই সাবধান থাকতে হবে, কারণ কোমরের অতিরিক্ত মেদ এক ধরনের ক্যামিকেল নিঃসরণ করে যা ইনসুলিন সিস্টেমের ক্ষতি করে, প্রেগনেন্সির সময়ে ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে, জন্মের সময়ে শিশুর ওজন ৪.৫ কেজির বেশি হলে, টিউবারকিউলোসিস, হাইব্লাডপ্রেসার, হাই ট্রাইগ্লিসারিড, কোলেস্টেরল থাকলে ডায়াবেটিসের রিস্ক বেড়ে যায়। স্টেরয়েড, ওরাল কনট্রাসেপটিভের দীর্ঘদিন ব্যবহারে ব্লাডে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায়। মহিলাদের বডিমাস ইনডেক্স ৩০ এর বেশি হলে ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা বেশি।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের তিনটি পদ্ধতি হল: মেডিকেশন, নিউট্রিশন এবং এক্সসারসাইজ। মেডিকেশন-প্রাথমিক স্তরে টাইপ-২ ডায়াবেটিকের জন্য ডায়েট, এক্সসারইজের সঙ্গে কিছু ঔষধও খেতে হবে। আর পরের স্টেজে প্রয়োজনে ইনসুলিন দিতেও হতে পারে। ডায়েট-প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার, যেমন গোটা মুগ, শুটি, জোয়ার, গম বা ওই জাতীয় কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট ও শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। চিনি, গুড়, মধু, ক্যান্ডির মতো সিম্পল কার্বোহাইড্রেট এড়িয়ে চলতে হবে। প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে অবশ্যই ফল খেতে হবে। প্রতিদিন ক্যালরি ইনটেকের ১২-১৮% রাখতে হবে ডাল, মাছ ইত্যাদি প্রোটিন জাতীয় খাবার। ঘি, তেলে ভাজাভুজি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ভাপে বা মাইক্রেওয়েভে রান্না আরও ভালো। জ্যাম-জ্যালি-সস-চকোলেট-আইনক্রীম-কোল্ডড্রিংকস-ক্যান্ডি-জুস-পটেটোচিপস্ ও জাঙ্কফুড-ফাস্টফুড একদম এড়িয়ে চলতে হবে। চিনির বদলে জিরো ক্যালরি সম্পন্ন সুইটনার ব্যবহার করা যেতে পারে। সুগার লেবেল মেইনটেইনের জন্য মেথির রস খাওয়া ভালো। হাঁটা/জগিং/সাইকেল চালানো/সাঁতারকাটা ইত্যাদি নিয়মিত করা যেতে পারে। ময়দা ও রাইচ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ ময়দা সরাসরি গ্লুকোজ পরিণত হয়। বারবার অল্প অল্প করে হাই-ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যেতে পারে। প্রতিদিন সকালে অল্প পরিমাণে দারুচিনি বা কফির অভ্যাস করলে শরীরের কোষে গ্লুকোজ ট্রান্সপোট করতে ইনসুলিনকে সাহায্য করে। স্ট্রেস শরীরে অ্যাড্রেনালিন ও কটিসল হরমোন ক্রমাগত গ্লুকোজ সঞ্চালন করে। প্রানীজ ফ্যাট কম খেতে হবে। এতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বাড়ে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট। সদস্য, কার্যকরী পরিষদ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন, সিলেট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন