Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সবই যেন আপেক্ষিক হয়ে গেছে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশে সবই যেন আপেক্ষিক হয়ে গেছে। তা অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষাসহ মৌলিক-যৌগিক সব সেক্টরেই। কোথাও একটু আশার আলো দেখা দিলে সেখানেই যেন অন্ধকার ধেয়ে আসে অথবা অন্ধকার টেনে আনা হয়। যা সম্ভাবনা হয়ে দেখা দেয় তা-ই শঙ্কা হয়ে নেমে আসে। একবারে বাংলা প্রবাদ ‘যাহা লাউ-তাহাই কদু, যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্নর’র মতো। স্বাধীনতার পূর্বাপর থেকে এ ধারাতেই এগিয়ে যাচ্ছে বা টিকে আছে বাংলাদেশ।

দীর্ঘ এ সময়ে কতো সম্ভাবনাই না এসেছে আমাদের সামনে। কতো আশাই না দেখানো হয়েছে। তা দেখতে দেখতে ওইদিনের শিশুটি কৈশোর পেরিয়ে যৌবন শেষ করে বার্ধক্যে।

শিশু-কিশোরদের পাঠ্য থেকে শুরু করে যাবতীয় পাঠ-পঠন নষ্টের সব আয়োজন আমরা করে রেখেছি। জীবনের বাঁকে এরপরই যৌবন কাল। জীবনকে জীবন্ত করে রাখতে, সমাজ-সংসারকে সতেজ করতে শ্রেষ্ঠ সময় যৌবনকাল। বিশ্ব কবি তারুণ্যকে প্রকাশ করেছেন যৌবনের দূত হিসেবে।

বাংলা সাহিত্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জসিম উদ্দিন, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমানের মতো কবি-সাহিত্যিকের অমর সৃষ্টিগুলোও যৌবনকেন্দ্রিক। সেখানে আজ বড় শূন্যতা। নানা পারিপার্শ্বিকতায় যৌবন বরবাদ হচ্ছে অগুনতি মানুষের। তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা মন্দ কাজে। এত তাদের কর্মজীবন কর্মমুখর নয়, বরং শেষতক বার্ধক্যে ভাবনা-চিন্তা, ভুল স্বীকার, আফসোসে ইহলীলা সাঙ্গ হচ্ছে।

হতাশার বিপরীতে আশা, আলোর বিপরীতে অন্ধকার, ভালোর উল্টোদিকে মন্দ থাকবে, এটাই জাগতিক নিয়ম। প্রকৃতির ব্যাকরণ। তাই বলে বাংলাদেশে এ বিপরীতের বৈপরিত্য যে মাত্রায় তাকে আদৌ প্রাকৃতিক বলা যায় কিনা, তা মোটাদাগের প্রশ্ন। দুয়ে দুয়ে যোগ করলে চার হওয়ার মতো বিষয়েও আমরা এক হতে পারি না। এর আগে-পিছে, যদি, কিছু, তবে ধরনের কতো কথা যুক্ত হয়ে যায়। রাজনীতি-অর্থনীতি এমন কি মৃত্যুর মতো ধ্রুব সত্য নিয়েও মত-দ্বিমত তৈরি হতে সময় লাগছে না। জন্ম-মৃত্যুকেও করে ফেলা হয়েছে ঘোষণার বিষয়। সনদ প্রশ্নে জন্মতারিখ আগপিছ হওয়ার সংস্কৃতি আমাদের আছে। বিশেষ কারো সায় না থাকলে মৃত্যু ঘোষণাও পিছিয়ে দেয়ার সংস্কৃতিতেও আমরা মাথা দিয়ে ফেলেছি। আর বাকি থাকলো কী?

আমাদের এ দৈন্যের বীজটা কোথায় রোপিত? পুরোটাই সামাজিক, না চারিত্রিক? না রাজনৈতিক? এ নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু নিস্পত্তি বা ফয়সালা মেলা কঠিন। কারণ, এ ট্রেনটি এখন পুরোদমে চলমান। চেইন টেনে যে কোনো জায়গায় ট্রেন থামানোর মতো শক্ত হাতের কোনো লক্ষণ নেই। এককথায় বা এক বাক্যে কোনো ফয়সালা টানা কঠিন করে দিয়েছে ধাবমান ট্রেনটি। এখানে পক্ষ বা মহলের শেষ নেই। সবাই শক্তিমান। যার যার সিদ্ধান্তে অটল। কেউ অবুঝ নয়। ভক্ত-সমর্থকও প্রচুর তাদের। দেশ ভীষণ ভালো চলছে, এ দাবির প্রতি সমর্থক গুনে শেষ করার মতো নয়। সব শেষ, দেশ বলতে আর কিছু নেই, এ মতের পক্ষেও বহু মানুষ। এ সংস্কৃতির মূল বীজটি পোতা আছে রাজনীতির উঠানে। দুয়েকবার ব্যত্যয় ঘটলেও দেশে পাঁচ বছর অন্তর রাজনৈতিক সংকট আসে। কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনা যোগ হয়। এরপর একটা ফয়সালা আসে। কারো কাছে এটি গণতন্ত্রের বিজয়, কারো কাছে গণতন্ত্রের সর্বনাশ। ভেতরে-ভেতরে আবার রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রেরে সংজ্ঞা বদলায়। পরিবর্তিত সংজ্ঞায় নিজেরা গণতন্ত্রের বিজয় হাতাতে চায়। খোলাসা করে বললে গণতন্ত্র, জয়, পরাজয়, উন্নয়ন-অবনতি সবকিছুর সংজ্ঞা-ব্যাখ্যা নিজেদের মতো। সাফল্যের সঙ্গে তারা মানুষকেও নিজেদের বুঝে শামিল করে নিতে পেরেছে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় তাদের জন্য যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক, নিজেদের সুবিধা আদায়ে চেষ্টা তারা এক রত্তিও কম করে না। সহিংসতা-আতঙ্ক তাদের কৌশল। কখনো কখনো অতিমাত্রায় সহিংসতার বিষয়টি থাকে উভয় দলের জন্যই নির্বাচনী লড়াইয়ের কৌশল হিসেবে।

আর নির্বাচনী রাজনীতির যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে কোনো দলই পুনর্নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার বা যেতে না পারার সংস্কৃতি চলছিল। প্রতিটি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন দলের কর্মকা- এমন ছিল যে, ভোটাররা বিরোধী দলকে ক্ষমতায় গিয়ে ভালো কিছু করে দেখানোর একটি সুযোগ দিতে উন্মুখ হয়ে থাকে। সেই সংস্কৃতি ভেঙ্গে দিয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। দুবার নয়, টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় তারা। চতুর্থবারের আয়োজনও পাকাপোক্ত। সঙ্কট আরো জটিল এখানেই। দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনে থাকবে, না গণতান্ত্রিক পথ খুঁজে পাবে তা বলার অবস্থা নেই। আর বলতে না পারারই জের হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাওয়া। দেশি-বিদেশি নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে, দেশের চলমান সঙ্কটের বীজটি লুকানো মতপ্রকাশ তথা ভোটাধিকার না থাকার মধ্যে। বিগত সংকট মুহূর্তগুলোতে সরকারি দলটি সব সময়ই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় এবং বিরোধীরা ক্ষমতায় আসে। এর ফলে সঙ্কট না কাটলেও কিছুটা ভারসাম্য আসে। আপাতত সাদা চোখে সেই সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

এ অনিশ্চয়তা-হতাশা এবং বিরোধ এখন আর দলে-দলে নয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান এমন কি সমাজের স্তরে স্তরেও। কোনো বিষয়েই এক হতে না পারা, যার যার সুবিধা মতো কথা বলা। সাদাকে সাদা না বলে লাভ-লোকসান দৃষ্টে কালো বলা, দরকার হলে হলুদ-লাল বলেও মত দেয়া। এ মন-মনন, শিক্ষিত-অশিক্ষিত,অর্ধশিক্ষিত সবার মধ্যেই কম-বেশি সংক্রমিত। সবকিছুতেই এমন বিরোধ আমাদের সম্ভাবনাকে সমস্যায় নিয়ে ঠেকাচ্ছে। আবার সঙ্কটকে সঙ্কট না বলে সম্ভাবনা বলে প্রতিষ্ঠা করে ছাড়া হচ্ছে। এর সাকুল্য ফলাফলে বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়ে খারাপ হয়ে গেছে, বলার লোকও আছে। দেশ সিঙ্গাপুরে চেয়েও উন্নত হয়ে গেছে বলার লোকও প্রচুর। আমাদের গ্রামগুলো এখন শহর হয়ে গেছে বলে মত আছে। আবার গ্রামসহ গোটা দেশ বস্তি হয়ে যাচ্ছে এমন মতও আছে, যার যার যুক্তির সঙ্গে তথ্যও আছে। উপমা আর গল্পের ঝুড়ি তো আছেই।

৭০, ৮০ ও ৯০ দশকজুড়ে গোটা দুনিয়ার সঙ্গে আমরাও এগিয়েছি। গড় আয়ু বেড়েছে, পায়ে জুতো উঠেছে, শরীরে কাপড়। কিন্তু তুলনায় বসলে হিসাবটা গোলমাল হয়ে যায়। ভিয়েতনাম বা মালয়েশিয়ার তুলনায় এখন আমরা বহু পেছনে তো বটেই, অতি সম্প্রতি আমাদের চেয়ে খুব খারাপ দশায় থাকা বহু দেশেরও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর রূপান্তর আমাদের চেয়ে অনেক গুণ বেশি ঘটেছে। আত্মতুষ্ট থাকতে চাইলে ভারতের কয়েকটি প্রদেশ কেবল সান্ত¡না দিতে পারে। এ কারণেই অগ্রগতিটা মাপতে হবে প্রথমত, আমাদের সম্ভাবনার সঙ্গে, কত সম্পদ তৈরি করে আমরা কতটুকু অর্জন করেছি। কিংবা, কত সম্পদ তৈরির সম্ভাবনা আমরা দুর্নীতি, অপচয় আর গোঁয়ার্তুমির কারণে নষ্ট করেছি। দ্বিতীয় মাপটা হলো আমাদের কাছাকাছি বা আমাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করা। এ তুলনা করতে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ। কারো কাছে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সিঙ্গাপুরে সঙ্গে তুলনা করার বড়াই, কারো কাছে শ্রীলঙ্কা, কঙ্গো, উগান্ডার চেয়েও মন্দ প্রমাণের তথ্য-সাবুদ। কারো শঙ্কা, কারো কাছে সম্ভনার। কারো প্রত্যাশা কারো কাছে হতাশার।


লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন