Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বাড়াতে হবে

মো. মাঈনউদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

দেশের সার্বিক অর্থনীতি বেশ কিছু ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, মূল্যস্ফীতি, খেলাপী ঋণ, ডলার সংকট ও সুদের হার নিয়ে। অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ডলারের বিপরীতে টাকার মানও নি¤œমুখী এবং দেখা দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রায় আয়-ব্যয়ের মধ্যে ঘাটতি। সরকারের সার্বিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, ব্যয় মেটাতে সরকার ঋণনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে, যা ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা। অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলায় আইএমএফের নিকট বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়েছে। আইএমএফের বিভিন্ন প্রতিনিধি দল ঋণ আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য কয়েকবার এ দেশে সফরও করে। বাংলাদেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদনও তুলে ধরে। ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে অ্যাকশন প্লানও তুলে ধরা হয়। এইসব বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা অনুমোদন করে। প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিলে এ অর্থ জমা হয়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ২৬৯ কোটি ডলার। এর আগে ছিলো ৩ হাজার ২১৯ কোটি ডলার। আইএমএফ বাকি ৪২২ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার ৬ কিস্তিতে ছাড় করবে। ৬ মাস পর পর কিস্তি পাওয়া যাবে। ২০২৬ সালে পুরো ঋণ পাওয়া যাবে।

আইএমএফের এই ঋণ পাওয়াতে আরও অন্যান্য সংস্থা যেমন, বিশ^ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাইকা থেকেও ঋণ পাওয়া সহজ হবে। আইএমএফের ঋণ পেতে ইতোমধ্যে সরকার গ্যাসের দাম দু’ দফা বাড়িয়েছে। জ¦ালানি তেলের দাম এক দফা ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। সারের দামও বাড়ানো হয়েছে। ফলে পণ্যমূল্য আরও বেড়েছে। মানুষের ভোগান্তি দিনদিন বাড়ছে। বৈশি^ক পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানিব্যয়ও বেড়ে যায়। আমদানি ব্যয়ের প্রবল চাপে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে রিজার্ভ কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য শংকার কারণ। ডলারের উপর চাপ বাড়ায় সামনে টাকার দাম আরও কমে যাবে। টাকার মান কমে গেলে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে আমদানিব্যয় ও পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। এটা মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আইএমএফের ঋণ ছাড় কতটুকু স্বস্তি দায়ক হবে তা দেখার বিষয়। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন, এই ঋণ পাওয়া অর্থনীতির জন্য সাময়িক সুখকর হলেও এটা পূর্ণ সমাধান বয়ে আনবে না। এই ঋণের সাথে যে শর্ত/পরামর্শ রয়েছে তা দেখতে হবে। এখানে আমাদের আর্থিক খাত গুরুত্ব পেয়েছে। কর-জিডিপি বাড়াতে হবে। সংস্কার করতে হবে ব্যাংক খাতকে। নামিয়ে আনতে হবে খেলাপী ঋণ। আইএমএফের ঋণের টাকা সঠিকভাবে সঠিক কাজে ব্যবহার না করলে সমস্যার সমাধান তো হবেই না, বরং দেশের গভীর গর্তে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে আইএমএফ যে পরামর্শ দিয়েছে তা পরিপালনে ব্যর্থ হলে ঋণ আটকেও যেতে পারে। এ ঋণের সাথে তিন খাতের সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব পদ্ধতি ঠিক করা, জিডিপির তুলনায় অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের হার বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া জ¦ালানির মূল্য নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মান-পদ্ধতি কার্যকর করা। আয়কর আইন সংসদে পাস করা। আদায়ের অযোগ্য খেলাপী ঋণ বিষয়ে আলাদা কোম্পানি গঠন করা, কর ছাড়ের উপর বিশদ নিরীক্ষা করা ইত্যাদি। আরো রয়েছে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল-দাম সমন্বয় করা, বাজেট থেকে সঞ্চয়পত্রকে আলাদা করা, ব্যাংকখাতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের সীমা তুলে নেওয়া, নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ও সুদের হারের নির্দিষ্ট সীমা প্রত্যাহার করা ইত্যাদি। আসলে বিদেশি এসব ঋণ অর্থনীতির জন্য সুষ্ঠু সমাধান নয়, সমস্যা কিছুটা সমাধান এর দ্বারা হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ সমাধানের জন্য নীতি ও পদক্ষেপ নিতে হবে। ঋণ যাতে কাজে লাগে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিক খাতকে সুনির্দিষ্ট কাঠামোয় সংস্কার করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বর্তমানে খেলাপী ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৬০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপী ঋণ ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপী ২ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা, বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপী ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। খেলাপী ঋণের কারণে দেশের ব্যাংকখাতের অবস্থা দিনদিন নাজুক হচ্ছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপী গ্রাহকদের বিরুদ্ধে কালক্ষেপণ না করে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। খেলাপী ঋণ বৃদ্ধির ধারা দেশের ব্যাংকখাত, ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থাৎ সার্বিক অর্থনীতির জন্য অশনি সংকেত। ঋণ যাতে কুঋণ না হয় সে ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে যথেষ্ট সজাগ থাকা উচিত। ঋণ যাতে খেলাপী না হয় সে জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপী ঋণের মামলা নিস্পত্তিতে যুগোপযোগী আইন প্রয়োজন। রাজনৈতিক ও পেশীশক্তির প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে ব্যাংকারদের কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। অর্থঋণ আদালতে মামলা দ্রুত নিস্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আইএমএফ খেলাপী ঋণ কমানোর ব্যপারে যে পরামর্শ দিয়েছে তা কমানোও একটি চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসা উচিত।

সরকার বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের নানা সুবিধা দিয়ে থাকলেও ব্যবসায়ীরা সেভাবে এগিয়ে না আসায় খেলাপী ঋণ বৃদ্ধিসহ ব্যাংক খাতে নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের অর্থনীতিতে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন থাকলেও দেশের অভ্যন্তরে যে সম্পদ রয়েছে তার সঠিক প্রয়োগ ও ব্যবহারে যদি স¦চ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায় তাহলে দেশের অর্থনীতিকে ক্রমান্বয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। বর্তমানে মেট্রোরেলসহ যে মেগা প্রকল্পগুলো রয়েছে, তার অধিকাংশ বিদেশি ঋণ নিয়ে হচ্ছে। এ কারণে দেশে কয়েক বছরে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০২১-২০২২ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ১১১ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য পেয়েছে। অনুদানও ঋণ ধারাবাহিকভাবে পেয়েছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত ছিল ১৭ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের অর্থনীতি যে পর্যায়ে রয়েছে তা টেকসই করতে, অবকাঠামো উন্নয়ন ঘটাতে, বাজেট বাস্তবায়ন করতে, বিদেশি ঋণের বিকল্প নেই। তবে বিদেশি ঋণ নিয়ে যদি সঠিকভাবে কাজে লাগানো না যায়, অর্থনীতিকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে দাঁড় করানো না যায় তাহলে ঋণে দেশের নিঃস্ব হয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। মিসর ও শ্রীলংকার মতো দেশ তার উদাহরণ। অর্থনীতিকে টেকসই করতে হলে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি জবাবদিহিও থাকা চাই।

মাথাপিছু আয় যদি দ্বিগুণও হয় আর দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অসমতা যদি বেড়ে যায় তাহলে তাকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে বলা সমীচীন হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি বহুমুখী প্রক্রিয়া, যেখানে মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটবে, ন্যায়বিচার পাবে, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটবে, জবাবদিহি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে থাকবে। ফলে দেশীয় বা বিদেশি ঋণ হোক তার যথাযথ ব্যবহারও সেখানে থাকবে। গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় ঘাটতি হলো প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারা। বর্তমানে অর্থনীতিতে অস্থিরতা ও মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী অবস্থা, ব্যাংকখাতের নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি শুধু বৈশি^ক পরিস্থিতির কারণে নয়, বরং তাতে জবাবদিহি ও কাঠামোগত দুর্বলতার অভাবও কম দায়ী নয়। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি তা কমাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়াতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ ও রেমিট্যান্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আনয়নের জন্য প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে হবে। হুন্ডি রোধে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে প্রবাসীদের দোড়গোড়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলকে যেতে হবে। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সব ধরনের বিলাসী পণ্য আমদানি কমাতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপের কারণে আমদানি কমেছে বটে কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রায় পেমেন্টের পরিমাণ তেমন কমেনি। অভ্যন্তরীণ ব্যয় বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকিও কমাতে হবে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর উপর জোর দিতে হবে। রপ্তানি বাড়ানোর জন্য শুধু পোশাকখাতের উপর নির্ভর না করে সম্ভাবনাময়ী রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন