Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সউদী আরব-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের টানাপড়েন

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০৩ এএম

মার্কিন ঐতিহ্য ভেঙেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রথম বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। ট্রাম্পের ওই সফরে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কিছু ঘটার সম্ভাবনা। সব হিসাব তালগোল পাকিয়ে গোটা দুনিয়া দেখেছিল ‘শতাব্দীর চুক্তি’। ট্রাম্পের প্রশাসন, বিশেষ করে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘শতাব্দীর চুক্তি’তে একমত হয়ে ইসরাইলের দখলদারি মেনে নিয়েছিল সৌদি বলয়ভুক্ত বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র।

বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর সেই সম্পর্কের তাল কেটেছে বারবার। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট সউদী রাজপরিবারের কঠোর সামালোচক সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকা-ের পর সউদী আরবকে ‘অস্পৃশ্য রাষ্ট্র’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন জো বাইডেন। সেই সময় বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য সউদী আরবকে ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে। ‘মানবাধিকারের রক্ষক’ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ভাবমর্যাদা গড়ে তোলা জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছর পর বাধ্য হয়েই ছুটে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। এটি একটি সফর, এ সফরের ছবি তাঁর এই ভাবমর্যাদাতে কালি লাগিয়ে দিয়েছে।

সফরের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের ভিত আরও শক্ত করা। রাশিয়াকে চাপে ফেলা। ২০২১ সালের জুলাইয়ে বাইডেন সফর করেছেন ইসরাইল ও সউদী আরব। বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর ইসরাইল ও সউদী আরবের সম্পর্ককে স্বাভাবিককীরণের দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছিল ট্রাম্পের জমানায়। সেই ধাপে সউদী বলয়ভুক্ত দেশ আমিরশাহি ও বাহরাইন সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে ইসরাইলের সঙ্গে। দ্বিতীয় ধাপে সউদী তার আকাশসীমা খুলে দিয়েছে ইসরাইলের জন্য।

কাউন্সিলর অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এন হ্যাস সেদিন বলেছিলেন, বাইডেনের সউদী সফরের পিছনে ছিল ভারসাম্যের বিদেশনীতিও। আমেরিকা ও সউদী আরবের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ৭৫ বছরের। এই সম্পর্ক সহযোগিতামূলক। এর মূলে রয়েছে জ¦ালানি তেল সম্পর্কিত স্বার্থ। সউদী আরব প্রচুর তেল উৎপাদন করে। এর বিনিময়ে আমেরিকা নিরাপত্তার জন্য সউদী আরবকে সর্বাধুনিক অস্ত্র ও গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে। শীতল যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা ও সউদী আরব সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে হাতে হাত মিলিয়েছিল। বাইডেনের পুঁজি ছিল সেই ‘কোল্ড ওয়ার’- এর ইতিহাস। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, তেলের দুনিয়ার ইতিহাসের পরম্পরার কোনও মূল্য নেই।

বিশে^ তেল রপ্তানিকারক ১৩টি দেশের সংগঠন ওপেক কাজ করছে ১৯৬০ সাল থেকেই। সংগঠনটি তখন থেকেই বিশে^ তেলের সরবরাহ বৃদ্ধি ও কমানোর মাধ্যমে বিশ^ব্যাপী তেলের মূল্যের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। সংগঠনটি আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে ২০১৬ সালে, যখন এর সঙ্গে আরও ১২টি তেল উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশ যুক্ত হয়ে তৈরি হয় ওপেক প্লাস। সেই ওপেক প্লাসের সদস্য এখন রাশিয়াও। গোটা সংগঠনে সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ সউদী আরব। তাই পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই ইউরোপ আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, যাতে সউদী আরবকে খুশি করে বিশ^ব্যাপী সরবরাহ বাড়িয়ে তেলের দাম কমিয়ে আনা যায়।

সরবরাহ বাড়িয়ে তেলের দাম কমানো গেলে অনেক সুবিধা হতো। করোনার কারণে গোটা দুনিয়ায় যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার লাগাম টেনে ধরা যেত। এর সঙ্গে জড়িত ছিল আরও বড় ভূরাজনৈতিক স্বার্থও। তেলের দাম কমিয়ে আনা গেলে তা রাশিয়ার অর্থনীতিতে একটা বড় চাপ সৃষ্টি করত, যা পুতিনকে সমস্যায় ফেলত। সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য। উৎপাদনগত পদ্ধতির জটিলতা, দুর্নীতি ইত্যাদি মিলিয়ে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে রাশিয়ার খরচ ৪৫ ডলারের মতো। অর্থাৎ, তেলের দাম যদি ৬০ থেকে ৭০ ডলারের দিকে চলে আসে, তাহলে এক তৃতীয়াংশ ডিসকাউন্ট দিয়ে রাশিয়ার পক্ষে লাভ করা আর সম্ভব নয়। এটা জানে ওপেক প্লাসও।

সউদী আরবের ডি ফ্যাক্টো শাসক মুহাম্মদ বিন সালমানকে সে ব্যাপারে রাজি করানোর জন্য পশ্চিমের দেশগুলি দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা চালিয়েছে। ইউক্রেন আগ্রাসনের পর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সউদী আরবে গিয়ে বিন সালমানের সঙ্গে দেখা করে আসেন। ফ্রান্স তাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে আদর-আপ্যায়ন করে। জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যান সউদী আরবে। তবে সবচেয়ে আলোচিত সফরটি ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের।

সউদী আরবের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক তৈরি করা ছিল বাইডেন প্রশাসনের একমাত্র পথ। সব রকম সমালোচনার ঝুঁকি মাথায় রেখে বাইডেন নেমেছিলেন সউদী আরবের মাটিতে। মুহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। গার্ডিয়ানের সাংবাদিক বেথান ম্যাককার্নান লিখেছিলেন, বাইডেন তাঁর মধ্যপ্রাচ্যে সফরে আপস করতে বাধ্য হয়েছেন। তেলের কাছে হেরে গিয়েছে মানবাধিকার। মুখে নানা কূটনৈতিক বচন থাকলেও বৈঠকটি যে ছিল বিশে^ জ¦ালানি তেল সরবরাহ বৃদ্ধির এক মরিয়া চেষ্টা, সেটা কাউকে আর বলে দিতে হয়নি। নিজের দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের বিষয় তো ছিলই, জ¦ালানি তেলের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির বিশ^ সঙ্কট যতটুকু কমানো সম্ভব, সে চেষ্টাও তিনি করেন। আর রাশিয়াকে সঙ্কটে ফেলার অতি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য তো ছিলই। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা।

সউদী আরব ও আমিরশাহির নেতারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে সাড়া দেননি। বাধ্য হয়ে বিকল্প পথ খুঁজেছেন বাইডেন। মার্কিন প্রতিনিধিদল ছুটে গিয়েছে ‘চিরশত্রু’ ভেনিজুয়েলায়। অথচ, ভেনিজুয়েলার সঙ্গে আমেরিকা ২০১৯ সালে কূটনৈতিক সস্পর্ক ছিন্ন করেছিল। তখন থেকেই দেশটির উপর তেল নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়েছিল। আমেরিকা সেই তেল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাশিয়া প্রতিদিন বিশ^বাজারে যে ২৫ লাখ ব্যারেল তেলের যোগান দেয়, তা ভেনিজুয়েলা বা ইরান কেউ পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না। ইরান ও ভেনিজুয়েলার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাদের তেলক্ষেত্র এবং জাতীয় তেল সংস্থাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যা সময়াসাপেক্ষ প্রক্রিয়া। ফলে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের নেতৃত্ব দেওয়া দেশ সউদী আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহিই ছিল শেষ ভরসা। তারাই অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। বাজার স্থিতিশীল করার ক্ষমতা রয়েছে ওপেকেরই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন