পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পৃথিবীতে স্বাধীন রাষ্ট্রের সংখ্যা প্রায় ২শ’ আর ভাষার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। তবে বিশ্বের প্রায় ৮শ’ কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই শীর্ষ ২০টি ভাষায় কথা বলে থাকে। এর মধ্যে বাংলা ভাষাও রয়েছে। ভাষাভাষী লোক সংখ্যার হিসাবে সপ্তম স্থানে রয়েছে বাংলা। বিশ্বের প্রায় ৪ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলে। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিকÑঅর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর জাতিগুলোই বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে থাকলেও বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত দেশ ও জনসমষ্টির অবস্থান সে অর্থ সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। উন্নত সমরাস্ত্র, প্রযুক্তি ও অধিকতর প্রভাব সৃষ্টিকারী শিক্ষা-সংস্কৃতির বলে বলিয়ান ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দেশে দেশে রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বিশ্বের শীর্ষ ভাষাভাষীদের স্থান দখল করে নিয়েছে। শত শত বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের উপর উপনিবেশিক শাসন চালিয়ে এখন পতিতপ্রায় পরাশক্তি গ্রেট বৃটেনের ইংরেজীভাষী জনসংখ্যা ৬ কোটির বেশি নয়। অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে ইংরেজী এখন বিশ্বের এক নম্বর ভাষা। ইউরোপের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২৭ কোটি, ভারতে ১৩ কোটি, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও নাইজেরিয়ায় প্রায় ৩০ কোটি মানুষের প্রধান ভাষা ইংরেজী। অবিভক্ত ভারতের কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান ইংরেজের ভাষা ও সংস্কৃতির কাছে কার্যত আত্মসর্মপণ করলেও নিজেদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে ত্যাগ করেনি বলেই উপনিবেশোত্তর বৃটিশ-ভারতে অনেকগুলো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সেই স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো তাদের স্বাধীনতার অনেকগুলো ঐতিহাসিকস ঘটনাক্রম পেরিয়ে এসে এখন পারস্পরিক অনাস্থা, আধিপত্য ও আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে। প্রযুক্তি ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আধিপত্য কায়েমের আগে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ভিত্তিগুলোকে দুর্বল করে দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রভূত সাফল্য অর্জনের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, নাভাজো ইন্ডিয়ান, অ্যাজটেক ও মেক্সিকানদের নেটিভ ভাষা ও ডায়লেক্টগুলোকে বিদায় করে খৃষ্টধর্ম, স্পেনিশ ও ইংরেজী ভাষা প্রচলনের মধ্য দিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। এ কারণেই তিনশ’ বছর উপনিবেশিক শাসন-শোষণ চালানোর পর প্রবল গণবিপ্লব ও সিভিল ওয়ারের মধ্য দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থানের পরও ইঙ্গ-মার্কিন আঁতাত এখনো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে আছে। নিজেদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় বহুমত ও পথের সহাবস্থান তথা মাল্টি-কালচারালিজমকে ধারণ করেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তির উপর আগ্রাসি থাবা বিস্তার করা উপনিবেশোত্তর পশ্চিমা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল এজেন্ডা। প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের উপর চাপ সৃষ্টি ও সম্মিলিত স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঐক্যের কারণেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাাদি অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়নি। মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশে এর বিপরীত চিত্রই বিদ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার তুলনায় অর্ধেক আয়তনের ভারতীয় উপমহাদেশ মুঘল বা বৃটিশদের হাতে শত শত বছর অখণ্ড থাকলেও উপনিবেশোত্তর বিচ্ছিন্নতা, অস্থিতিশীলতা ও অনাস্থার রসায়ন বুঝতে না পারলে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করা কখনোই সম্ভব হবে না।
ইউরোপে ইসলামের আগমন এবং সম্মিলিত পশ্চিমা শক্তির ক্রুসেডকে ব্যর্থ করে দিয়ে শত শত বছর ধরে রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে টিকে থাকার মধ্য দিয়েই ইসলাম অপেক্ষাকৃত উদার ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়। এ কথা ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পুঁজিবাদের বিকাশধারার শুরু থেকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ একই সঙ্গে অভিন্ন লক্ষ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিগোষ্ঠির উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের রেনেসাঁস বা এনলাইটেনমেন্টের ধারণার সাথে উপনিবেশিক লুন্ঠনকাণ্ড শুরুর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র বিদ্যমান। ভারতীয় উপমহাদেশ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর আধিপত্যবাদের নিয়ন্ত্রণ এখনো ইউরোপীয় উপনিবেশিকদের দেখানো পথেই নব্য আধিপত্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মানুষের প্রবণতা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অভিষ্ঠ ও বিকাশমানতার সাথে সাজুয্যপূর্ণ। এ কারণেই পশ্চিমারা আধুনিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা ও নিশানবরদারের দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ছেড়ে যাওয়া উপনিবেশ অঞ্চলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেনি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে এক ধরণের বাহ্যিক অবস্থান দেখা গেলেও দেশে দেশে তাদের সমর্থন মূলত বশংবদ অগণতান্ত্রিক শাসকদের প্রতি। স্নায়ুযুদ্ধের বিভাজনের সময় সমাজতন্ত্র বলয়ের সমর্থনপুষ্ট অগণতান্ত্রিক শাসকদের নিয়েই কেবল তাদের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সম্পর্কিত উচ্চকণ্ঠ বয়ান শোনা যায়। মিশরের সিসি আল ফাত্তাহ্ এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তা প্রায় একই প্রকারের অগণতান্ত্রিক-স্বৈরশাসক হলেও দুই পক্ষের প্রতি পশ্চিমাদের বিপরীত ভূমিকায় দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন নাশকতা এবং ওয়ার অন টেররিজমের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেন সরকার এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ, নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলে পশ্চিমাদের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতীয় রাজনীতিকদের বিভিন্ন লেখা, সাক্ষাৎকার এবং প্রকাশিত গ্রন্থাবলীতে তার স্বীকৃতি রয়েছে। তবে গত চৌদ্দ বছরে সামগ্রিক পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যাওয়ায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমাদের অবস্থানেও দৃশ্যত কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে বলে ধরে নেয়া যায়। কিন্তু আঞ্চলিক শক্তি ভারতের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বাংলাদেশের আগামি নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা সরকারের উপর অব্যাহত কূটনৈতিক চাপ সামাল দিতে অতীতের ধারাবাহিকতায় উচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় কূটনীতিকদের ঢাকায় উড়ে আসার ঘটনা সম্প্রতি আবারো ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা ডেরেক শোলের ঢাকা সফরের সময় আকস্মিক ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন খাত্রার ঢাকায় আগমন এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে মোদি সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ সমর্থনের ঘোষণা থেকেই তা প্রতিয়মান হয়। গত দেড় দশকে বাংলাদেশ ভারত সর্ম্পক অনেকটা এক তরফা ভারতীয় স্বার্থের সম্পর্কে পরিনত হয়েছে। বিশাল বাণিজ্য বৈষম্য আরো বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ভারতের অন্যতম প্রধান রেমিটেন্স আয়ের উৎসে পরিনত হয়েছে। বিশ্বের এক নম্বর জনশক্তি রফতানিকারক ও রেমিটেন্স আয়ের দেশ ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এক নম্বর রফতানিমুখী শিল্পখাত তৈরী পোশাক শিল্প এবং সেবা ও রফতানিমুখী বেসরকারী খাতের কর্মসংস্থানের বিশাল অংশ অবৈধ ভারতীয়দের দখলে। দেশে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেটধারী লাখ লাখ তরুণ চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে। তখন লাখ লাখ ভারতীয় অবৈধভাবে ওয়ার্ক পারমিট ছাড়াই বাংলাদেশের জব সেক্টরে কাজ করে বছরে শত শত কোটি ডলার পাচার করছে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কলেবর ও অবকাঠামো বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে মোটেও কম নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে অভিহিত করা হতো। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, রুয়েট, চুয়েটসহ অসংখ্য বিশেষায়িত পাবলিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শতাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম গড়ে তোলার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক ও প্রবাসিকর্মীদের হাত ধরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বুনিয়াদি শক্তির যোগানদাতা হয়ে উঠলেও দেশের প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা লজ্জাজনকভাবে ক্রমাবনতিশীল। দেশের গার্মেন্টস বায়িং হাউজগুলোতে হাজার হাজার ভারতীয় তরুন কাজ করার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সংশ্লিষ্টদের জবাব হচ্ছে, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বা কারিগরী প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা বেশিরভাগ তরুণ ইংরেজীতে কমিউনিকেশনে খুবই দুর্বল। কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে একটা ভাষা শিখতে দুই বছরের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সেখানে প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ১৮ বছর ধরে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করেও গার্মেন্টের ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে যোগাযোগের উপযোগী দক্ষ জনশক্তি না পাওয়ার ব্যর্থতা সত্যিই বিষ্ময়কর ও হতাশাজনক। আমাদের উচ্চশিক্ষা কর্মমূখী দক্ষতা, ব্যবহারিক উপযোগীতা কিংবা গবেষণার ক্ষেত্রেই শুধু ব্যর্থ হচ্ছে না, সেই সাথে শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান, মননশীলতার বিকাশ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক মতাদর্শের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, মুক্তবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চাও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হাতে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জিম্মিদশা এবং নির্যাতনের ঘটনা মাঝে মধ্যেই একেকটি ট্রাজিক পরিনতি হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভারতের সাথে অসম পানিচুক্তির প্রতিবাদ করে ফেইজবুকে পোষ্ট দেয়ার কারণে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে কয়েক ঘন্টা ধরে পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা, কিংবা সর্বশেষ ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রির দ্বারা জনৈক ছাত্রীর নির্যাতিত হওয়ার ভাইরাল ঘটনা পর্যন্ত ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গণগুলোর করুণ চিত্র বেরিয়ে আসে। দেশের শীর্ষ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে যেমন দেশের জন্য প্রয়োজনীয় বিশ্বমানের প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, গবেষক গড়ে উঠবে, একইভাবে সেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের চলমান সমস্যা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়েও জনমত ও মুক্তবুদ্ধির বিকাশ ঘটবে। বিশ্বে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী প্রতিভা ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন-অগ্রগতির আঁতুরঘর হচ্ছে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। অক্সফোর্ড, হার্বাড, কেম্ব্রিজ, এমআইটির মত প্রতিষ্ঠান ছাড়া বিশ্বের উপর ইউরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব কল্পনা করা যায়না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের জন্য একটি ফাঁকামাঠ তৈরী করেছে। এখানে ক্যাম্পাসে মুক্তবুদ্ধি চর্চার ন্যুনতম সুযোগও নেই। এমনকি কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও তার প্রাণনাশের হুমকি ও আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ছাত্রসংগঠনের টর্চার সেল, গেস্টরুম, গণরুমে শিক্ষার্থী নির্যাতনের মত ঘটনা বিশ্বের আর কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। বছরের পর বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিভৎস সব ঘটনা ঘটে চললেও এ বিষয়ে প্রশাসনের নিরবতা তাদের নিরব সমর্থনেরই প্রমান।
ইসলামের সাথে পশ্চিমাদের ঐতিহাসিক ক্রুসেড বিগত শতকের বিশ্বযুদ্ধ এবং পরবর্তী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে ওয়ার অন টেররিজম পর্যন্ত এখনো ধারাবাহিকভাবে বিদ্যমান। পশ্চিমা তাত্ত্বিকরা একে বলছেন, ক্লাশ অব সিভিলাইজেশন্স। অষ্টাদশ শতকের ইউরোপে সেই তথাকথিত এনলাইটেনমেন্টের যুগে ফরাসী লেখক, দার্শনিক ভলতেয়ার খৃষ্টান ধর্ম ও চার্চের বিরুদ্ধে প্রবল সাহসে কলম ধরে শাককদের রোষানলে পতিত হয়ে বার বার কারাবারণ করতে বাধ্য হয়েছেন। শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে নব্য পুঁজিবাদের সমর্থক ভলতেয়ারের ধর্ম বিরোধিতা খৃষ্টধর্মেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি খৃষ্টধর্ম ও সামন্তবাদ বিরোধী কাঁদিদ উপন্যাস রচনার পাশাপাশি ইসলামের নবী এবং খলিফাদের নিয়েও বিভ্রান্তিকর নাটক লিখে সমালোচিত হয়েছিলেন। সে সময়ের বেশ কয়েকজন ফরাসী ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইসলামের নবী সম্পর্কে মিথ্যা ও মানহানিকর রচনার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সেন্ট হেলেনার কারাগারে বন্দী অবস্থায় ভলতেয়ারের ‘মাহোমেত’ নাটকের কঠোর সমালোচনা করে চিঠি লেখার পর ভলতেয়ার মোহাম্মদ (স.) সম্পর্কে তার মতামত সংশোধন করে এক মহান ব্যক্তিত্ব বলে অভিহিত করেন। তবে মুসলিম বিশ্বে উপনিবেশ ও দখলদারিত্ব কায়েমকারী ফরাসিদের ইসলাম বিদ্বেষের নমুনা এখনো মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হতে দেখা যায়। তারা গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা নিয়ে কথা বলেন, সেই সাথে তাদের দেশে ব্লাসফেমি আইন বলবৎ থাকলেও সেখানে প্রায়শ ইসলাম নিয়ে কটাক্ষ, ইসলামের নবীর কার্টুন এবং কোরআন অবমাননার ঘটনা নিয়ে মাঠ গরম করার তৎপরতা দেখা যায়।
পশ্চিমা বিশ্বের ইসলাম বিদ্বেষ ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের মধ্যে সংক্রামিত হওয়ার পেছনে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির দায় রয়েছে। ভারতের এক শেণীর উচ্চশিক্ষিত রাজনীতিবিদ ও অ্যাকাডেমিসিয়ান বৃটিশদের রাজার জাত জ্ঞান করে স্বেচ্ছায় মনোজাগতিকভাবে তাদের দাসত্ব মেনে নিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে তারা মুসলমান সুলতান ও মোগলদের বশ্যতাও মেনে নিয়েছিল বলেই ৮শ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। দাক্ষিনাত্য থেকে আসা পাল ও সেন রাজাদের মাৎস্যন্যায়ের যুগে এই বাংলায় বখতিয়ার খলজির নেতৃত্বে মুসলমানদের আগমন ছিল মুক্তির আলোকবর্তিকা স্বরূপ। অধ:পতিত ও বিশৃঙ্খল সমাজে ঐক্য, সাম্য ও সাংস্কৃতিক -অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির সোপান নির্মান করেছিলেন প্রথম যুগের মুসলমান শাসকরা। দুইশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন-বঞ্চনার মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের ভীতকে টলানো যায়নি বলেই ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। বাংলার মুসলমানরা স্বেচ্ছায় সেখানে যোগ দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী মুসলমানরা বিশ্বের একমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে শতকরা ৯০ভাগ মুসলমানের বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইয়ে প্রথম যুগের মুসলমান শাসকদের সম্পর্কে বিকৃত ও মিথ্যা ইতিহাস শেখানো হচ্ছে কি কারণে, কার স্বার্থে? ইতিহাসের অনিবার্য বাস্তবতায় আমরা একটি ধর্মভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র গঠন করেছি। সেই রাষ্ট্রের গড়ে ওঠা ও ভবিষ্যতের পানে অভিযাত্রার সব সম্ভাবনার সাথেও জড়িয়ে আছে ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতীয় ঐক্য ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রশ্ন। আমাদের সন্তানদের কেন মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাসের বদলে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির পাঠ্যক্রম গ্রহণ করতে হবে! পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম বাংলা অত:পর লন্ডনে স্থায়ী নিবাস শেষে সেখানেই মৃত্যুবরণকারী বাঙ্গালী লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেননি। তার লেখা আত্মঘাতী বাংঙ্গালী গ্রন্থে ১৮১৭ সালে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য চর্চার সূচনাকে বাঙ্গালীর পুনর্জন্ম বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এর দ্বিতীয় ভাইস চ্যান্সেলর স্যার হেনরি স্যামনার মেন’র অবসরের পর ১৮৭১ সালে লন্ডনে দেয়া একটি বক্তব্য নীরদ চৌধুরী তার বইয়ে ইংরেজী কোটেশন আকারে উদ্ধৃত করেছেন। সেখানে তিনি যা বলেছেন, বাংলা ভাবার্থে তার অর্থ দাঁড়ায়- তিনি ভারতের বাংলায় হিন্দুদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন তথা ইউরোপের অনুকরণ দেখেছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। এমন উদাহরণ তিনি আর কোথাও দেখেননি। বাঙ্গালী হিন্দুরা বৃটিশদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য মেনে নিলেও পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তা মেনে নেয়নি বলেই তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হয়েছে। সে রাষ্ট্র এখন প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নগ্ন হস্তক্ষেপের শিকার। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সেই কালোহাতের বিস্তার আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিতে সদা তৎপর রয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।