পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
টিলা বা পাহাড় ধ্বসে মৃত্যুর খবর নতুন নয়। প্রতি বছরই দেশের বিভিন্ন স্থানে মর্মান্তিক এসব ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। প্রাণহানি ছাড়াও ঘর বাড়ীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলা, সিলেট, কুমিল্লা, গাজীপুর, বগুড়াসহ সারাদেশেই নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বনাঞ্চল উজাড় এবং পানির উত্তোলন প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে, তাতে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে পাহাড় টিলা নেমে আসাটা অস্বাভাবিক নয়।
বাংলাদেশে খুব উচুঁ পাহাড় নেই। আমাদের দেশে পাহাড় বলতে আমরা যা বুঝি, তা মাটির উচ্চ টিলা মাত্র। টিলাই হোক আর পাহাড়ই হোক; এই সুউচ্চ ভূমি বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এগুলোতে প্রচুর গাছ, বৃক্ষ, তরু-লতা প্রকৃতির অকৃপণ আর্শীবাদে বেড়ে উঠে। এসব পাহাড় বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখীর অবাধ বিচরণ স্থল। এসব পাহাড়ের মধ্যে সৃষ্ট প্রাকৃতিক হ্রদ পানির যোগান দেয় এবং নানাভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করে। ১৯৮০-৮১ সাল থেকে ব্যাপকভাবে পাহাড় কাটা শুরু হয়। এরপর পাহাড় কাটা বন্ধ করে আইন পাশ হয়। কিন্তু পাহাড় কাটা কার্যত বন্ধ হয় না। সিলেট, চট্টগ্রাম বা অন্যান্য স্থানে পাহাড়-টিলা কাটার অন্যান্য অশুভ প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে, মহানগরীর নালা-নর্দমা তথা পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এদিকে সিলেট অঞ্চলের সুরমা বা চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে প্রতি বছর পলি জমে জমে নদী গর্ভ ভরাট হয়ে চলেছে। শহরে কোন স্থান ভরাট করার প্রয়োজন হলে ঐ স্থান থেকে মাটি তুলে এনে সহজে ভরাট করা যায়। কিন্তু তা না করে পাহাড় কেটে ঐসব জায়গা ভরাট করে বিপদ ডেকে আনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রত্যেক সরকারের আমলে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কিছু কিছু বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, সমন্বয় কমিটির নামে কিছু কিছু বিবৃতিও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এগুলো স্রেফ কথার কথায় পর্যবসিত হয়। চট্টগ্রাম বা সিলেট শুধু নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেই পরিবেশ বিপর্যয়ের সংবাদ আমরা পত্র-পত্রিকায় পাঠ করে থাকি। সিলেট বা চট্টগ্রাম মহানগরীর উচ্চ পাহাড়গুলো নিধনের ফলে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও মাত্রায় ইতোমধ্যে হেরফের হয়ে গেছে। ১৯৮০-৮১ সনের পূর্বেকার গড় বৃষ্টিপাতের সাথে বর্তমানের গড় বৃষ্টিপাতের তুলনা করলে এ পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে উঠবে। এভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। নদী-নালা হতে মাটি এনে প্রয়োজনীয় ভরাট কাজ চালানো যায় এবং এটা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিলেট, কক্সবাজার, বান্দরবন সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এবং বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীরা অভিমত প্রদান করে সরকার ও জনগণকে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নে সাহায্য করতে পারেন।
অপ্রিয় হলেও সত্য যে, প্রচলিত আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনপূর্বক একশ্রেণীর দুর্বৃত্ত ও অর্থলোভীদের কারণে সিলেট, চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশে-পাশের পাহাড়গুলো এখন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, আত্মঘাতী এই নাশকতামূলক কাজ সম্পর্কে অগণিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বহু চিঠিপত্র লিখেছেন দায়িত্বশীল সচেতন নাগরিকরা। কিন্তু আত্মঘাতী এই দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষার কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং দুর্বৃত্তরা বহাল তবিয়তে পাহাড় নিধনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় যে, চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী, পাহাড়তলী, খুলশীতে পাহাড় নেই বললেই চলে। হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ড থানায় বহু পাহাড়ের অস্তিÍত্ব এখন বিলীন হতে চলেছে। কর্ণফুলীর অপর পাড়ে সুদৃশ্য পাহাড়ও বিলুপ্তির পথে। সিলেটেও একই অবস্থা। সিলেট নগরীর চারপাশের সুদৃশ্য পাহাড় বা টিলা এখন নেই বললে চলে। পাহাড় কাটা আইনতঃ নিষিদ্ধ। তবে আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না। সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্ত দল পাহাড় কেটে চলেছে। পাহাড় কাটার জন্য এক শ্রেণীর সন্ত্রাসীর নেতৃতেৃ ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে উঠেছে। এরা বিভিন্ন রিয়াল এস্টেট ও কলকারখানার জন্য কেনা জমিতে মাটি সরবরাহ করে। এ কাজে বিপুল অর্থের লেনদেন হয়। অভিযোগ রয়েছে, মাটি সরবরাহকারী সিন্ডিকেট, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা কাজে নিয়োজিতদের একাংশ এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজসে এ কাজ করে। সিন্ডিকেট বিশেষ রাজনৈতিক দলীয় ক্যাডারদের মদদ পায়। পাহাড়-জমির মালিক সরকার। সরকার বিভিন্ন ব্যক্তিকে পাহাড় ইজারা দেয়। কোন কোন ইজারার মেয়াদ ৯৯ বছর। এভাবে বেসরকারী নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ফলে পাহাড় নিধন কর্ম দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
মহান আল্লাহ পাহাড়-পর্বত-নদী-সাগর, ভূ-প্রকৃতি সৃষ্টি করেছেন ভারসাম্য বজায় রাখান জন্য। এর ব্যত্যয় বা ব্যতিক্রম ঘটালে তা শুধু প্রকৃতিতে নয়, গোটা পরিবেশেই সৃষ্টি হয় বিরূপ প্রতিক্রিয়া। গঙ্গা নদীর যে স্রোতধারা পদ¥া দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল ভারতীয় অংশে ফারাক্কা বাঁধ সে মূল স্রোতধারা বন্ধ করার ফলে আজ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল জুড়ে শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। গ্রীষে¥ গরম আর শীতে তীব্র শীত। হিমালয় এলাকার ঘন বনরাজি নিশ্চিহ্ন হওয়ার ফলে আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে শৈত্য প্রবাহ বয়ে যায় বলে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। সিলেটের বুকে ভূ-প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাকারী টিলা-পাহাড় যারা নিধন করে চলেছে, তারা হয়ত জানতে বা বুঝতেও পারছে না প্রকৃতির কি নিদারুন ক্ষতি করে চলেছে। আজ হোক, কাল হোক প্রকৃতি যখন এর প্রতিশোধ নিতে শুরু করবে, তখন ঐ প্রতিশোধ যারা পাহাড় কেটে চলেছে, শুধু তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এর কুফল পেতে হবে দেশবাসীকে। কিছু দুর্বৃত্তের অপকর্মের মূল্য দিতে হবে গোটা জাতিকে। সুতরাং কাল বিলম্ব না করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সিলেটের টিলা/পাহাড় নিধন বন্ধ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ সকল মহলকে তৎপর হতে হবে।
আমার দীর্ঘ সিলেটে অবস্থানকালে লক্ষ্য করেছি, ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরাই পাহাড়/টিলা কেটে ধ্বংস করার অপকর্ম করছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সিলেট শহর থেকে ৮/১০ মাইল পর্যন্ত দূরত্বের বেশীরভাগ টিলাই কেটে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব টিলার মাটি কেটে শহর বা শহরতলীর বিভিন্ন বসতবাড়ী আবাসিক এলাকা পুকুর ইত্যাদি ভরাট করা হচ্ছে। বিত্তবান আর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং পুলিশ বিভাগের লোকদের সহযোগিতায় সিলেটের হাজার হাজার একর টিলাভূমি নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। সিলেট শহরের পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণসহ চারপাশের ঢেউখেলা পাহাড় শ্রেণী আজ আর চোখে পড়ে না। ছোট ছোট যে কয়টি টিলা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলোরও নিধন চলছে। পাহাড়-টিলা কাটার কাজে প্রতিদিন শতশত শ্রমিক ও ট্রাক নিয়োজিত রয়েছে। নিধন চলছে সংঘবদ্ধভাবে। পরিতাপের বিষয়, যাদের এসব অপরাধমূলক কাজে বাধা দেয়ার কথা তারা নীরব ও নির্বিকার। কোন সময় পাহাড় বা টিলা কাটার দৃশ্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চোখে পড়লে এবং ২/১টি ট্রাক আটক করা হলেও তার পিছনে থাকে অন্য উদ্দেশ্য। কিছুদিন আগে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে টিলা ও পাহাড় কাটার ব্যাপারে নতুন যে প্রাক্ষলণ জারি করা হয়েছে, একজন পরিবেশ কর্মী হিসাবে এটি পূনর্বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এটাতে আইনের ফাঁক-ফোকর রয়েছে।
আজকাল শুধু ভাল কথা, নীতিবাক্য আর সদাচরণের মৌখিক আহবানে কোন কাজ হয় না। এর জন্য নীতি ও নিয়মের পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োজন। সে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশ প্রেমের দরকার। যারা পাহাড় কাটছে, পাহাড় ন্যাড়া করছে এবং পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে, এসব ব্যর্থতার দায় শুধু তাদের নয়, এর দায় স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বেশি। নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকাণ্ড জোরদার করার ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যা এবং কারা এসবের পিছনে সক্রিয় রয়েছে-এ বিষয়গলো ভালভাবে খতিয়ে দেখে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জননিরাপত্তা, পাহাড়ের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা আজ অপরিহার্য। এ কাজটি যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেজন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আমরা আশা করব চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, বগুড়া, কুমিল্লাসহ সারা দেশের পাহাড়-টিলা যেটুকুই অবশিষ্ট আছে, তা সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণীত হোক। একই সাথে সে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও কঠোর মনোভাব ও ব্যবস্থা গৃহীত হোক। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র কথা চিন্তা করে সকল নাগরিককে সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। আমি এ ব্যাপারে একজন পরিবেশকর্মী এবং প্রবীন সাংবাদিক হিসাবে সিলেটের প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। আমাদের এ মুহূর্ত থেকে এ ব্যাপারে সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে। গ্রহণ করতে হবে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, যাতে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি পাহাড় নিধন। আমরা চাই না, শুধু সুশ্রী, সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর চট্টগ্রাম বা সিলেটের পরিচয় স্রেফ ইতিহাসে পরিণত হোক। আমরা সুস্থ শরীর ও মন, সুন্দর পরিবেশ ও প্রকৃতি নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে চাই। ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য সুন্দরতম নিরাপদ ও দূষণমুক্ত পরিবেশ রেখে যেতে চাই। আর এটা এককভাবে সম্ভব নয়। এখানে প্রয়োজন স¤িমলিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। সিলেট ও চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের প্রতিরোধব্যুহ রচনার সময় এসেছে। আশা করি, তারা এগিয়ে এসে সক্রিয় হবেন।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স^র্ণপদক) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।