পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তার প্রেরণা ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল। বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিগঠণে ভাষা মূল উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগে অনুপ্রেরণার বাতিঘর হিসেবে যে ক’জন মহাপুরুষকে ইতিহাসে চিহ্নিত করা যায়, তাদের মধ্যে অধ্যাপক আব্দুল গফুর অন্যতম। পাকিস্তান আন্দোলন ও ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায় ২ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাশেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী ও অধ্যাপক আব্দুল গফুরের নেতৃত্বে তমুদ্দন মজলিশ গঠিত হয়েছিল। তমুদ্দন মজলিশই প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে সামনে এনে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অধ্যাপক আব্দুল গফুর ছাড়া তমুদ্দন মজলিশ ও ভাষা আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব কেউ আর বেঁচে নেই। বাঙ্গালী মুসলমানের বিগত শত বর্ষের গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী ও আত্মনিবেদিত কর্মী অধ্যাপক আব্দুল গফুরের জন্মও ফেব্রুয়ারি মাসের ১৯ তারিখ। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ৯৫ বছর বয়সে পা দিয়েছেন। এখন তিনি কিছুটা স্মৃতিভ্রষ্টতা এবং বার্ধক্য জণিত স্বাস্থ্যসমস্যায় আক্রান্ত। জীবনে নিজের ভবিষ্যতের জন্য কিছুই করেননি। এই অন্তিম সময়ে অর্থাভাবে তার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যয় চালিয়ে যাওয়া তার পরিবারের পক্ষে দুর্বহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে রাষ্ট্র এবং ভাষার জন্য তিনি যৌবনের শুরু থেকে সারাজীবন কঠোর সাধনা করেছেন সেই রাষ্ট্র ও সরকারের কি দায় নেই তার মতো ভাষাসৈনিক ও দেশপ্রেমিক-জ্ঞানসাধকের পাশে দাঁড়ানোর?
অধ্যাপক আব্দুল গফুর কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে কাজ করেননি। বৃহত্তর ফরিদপুরের সন্তান হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ থাকলেও তিনি কখনোই কোনো সরকার বা রাষ্ট্রশক্তির কাছে বৈষয়িক কোনো দাবি নিয়ে দাঁড়াননি। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৫ সালে একুশে পদক প্রদান ছাড়া রাষ্ট্র কিংবা কোনো সরকার এই মহান ভাষা সৈনিকের পাশে দাঁড়ায়নি। যেখানে দেশের হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে মাসিক ভাতা পাচ্ছেন, সেখানে ৯৫ বছর বয়েসী ভাষাসৈনিক আব্দুল গফুরকে এখনো নিজের আয়ের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশের শুরু থেকেই তিনি এই পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক-কলামিস্ট, ফিচার এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। ইনকিলাব তাঁকে ছেড়ে দেয়নি। ইনকিলাব কর্তৃপক্ষ পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। উন্নততর চিকিৎসা ও সেবা নিশ্চিত করা গেলে অধ্যাপক আব্দুল গফুর সুস্থ হয়ে হয়তো আরো কিছুদিন জাতির কল্যাণে কাজ করে যেতে পারবেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, তিনি জাতীয় সম্পদ। ভাষা আন্দোলনের জীবন্ত ইতিহাস। দুঃখের বিষয়, সরকার ও রাষ্ট্র তার পাশে দাঁড়াচ্ছে না। অবহেলা এবং উপেক্ষার স্বীকার হয়ে আছেন। সরকার স্বাধীনতাযুদ্ধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা দেশি-বিদেশি ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কীর্তিমানদের সম্মাননা ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়ালেও অধ্যাপক আব্দুল গফুর রয়ে গেছেন তার বাইরে। জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জারও বটে। অথচ তার চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা এবং জাতীর সম্পদ হিসেবে তুলে ধরা সরকার ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
অধ্যাপক আব্দুল গফুরের মত ব্যক্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। বাংলাভাষা ও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নিশানবরদারের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁর প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, কর্মতৎপরতা এবং সারাজীবন ধরে অসংখ্য লেখা আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও মণীষার অন্যতম অংশ হয়ে আছে। তমুদ্দন মজলিশ ও ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির পাশাপাশি ১৯৪৭ সালে পাক্ষিক জিন্দেগি পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দিয়ে অদ্যাবধি সক্রিয় থেকে সম্ভবত তিনিই এদেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় ধরে পেশাদার সাংবাদিকতাকে ধরে রেখেছেন। অধ্যাপক আব্দুল গফুরের অন্তিম সময়কে সুগম ও স্বচ্ছল রাখতে তাঁর পাশে দাঁড়ানো সরকার ও রাষ্ট্রের অবশ্য কর্তব্য। অনেক শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীর দু:সময়ে ও চিকিৎসা সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরাজ হাত প্রসারিত হতে আমরা দেখেছি। অধ্যাপক আব্দুল গফুরের জন্যও তিনি সুপ্রসন্ন হবেন, এটা আমাদের প্রত্যাশা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ দেশের সাংবাদিক-পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোতে অধ্যাপক আব্দুল গফুরের অসংখ্য ছাত্র, শুভাকাক্সক্ষী রয়েছেন। তারা অধ্যাপক আব্দুল গফুরের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে তা হবে সৌহার্দ্য ও মানবিক দায়বদ্ধতার অনন্য উদাহরণ। অধ্যাপক আব্দুল গফুরের এখন আর কোনো পদকের প্রয়োজন নেই। তার প্রয়োজন সুচিকৎসা এবং আর্থিক সহায়তা। সরকার ও রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না। দেশের সম্পদ হিসেবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো সকলের দায়িত্ব।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।