পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হলো ভাষা। এই ভাষা মানবজাতিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন-ই শিক্ষা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনুল করীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন আল কুরআন। সৃষ্টি করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা।’ (সূরা আর-রহমান)। পৃথিবীতে সাত হাজারের অধিক ভাষা রয়েছে। পৃথিবীকে নানান ভাষা আর সংস্কৃতি আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। আমরা জন্মসূত্রে মায়ের কাছ থেকে যে ভাষা পেয়েছি সেটিই আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা ‘বাংলা’। এই ভাষায় আমরা কথা বলি, স্বপ্ন দেখি। হৃদয়ের সকল আশা-আকাক্সক্ষা, আবেগ-অনুভূতি, সুর আর ছন্দ এই জায়গায় মিলেমিশে একাকার। পৃথিবীর যে কোন ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ, দরদ ও মর্যাদা অতুলনীয়। মাতৃভাষা প্রত্যেক জাতির জন্যই চির অহংকার ও গর্বের। বাঙালি জাতির কাছে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা অনেক উচুঁতে। কারণ পৃথিবীতে আমরাই ভাষার জন্য লড়াই করেছি, জীবন উৎসর্গ করেছি। আমাদের স্বাধিকার ও আত্মচেতনার বহিঃপ্রকাশ এই ভাষার মাধ্যমেই। বিশ্বের মানচিত্রে লাল-সবুজের যে পতাকা আজ পত-পত করে উড়ছে, বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার ভিত্তি কিন্তু এই বাংলা ভাষার মাধ্যেই প্রোথিত। বাঙালি হিসেবে বিশ্বের বুকে আমাদের স্বীকৃতি ও পরিচয়ের জায়গাকে সুদৃঢ় করেছে আমাদের মাতৃভাষা।
মাতৃভাষা বাংলা আজ বিশ্বব্যাপী অনন্য মর্যাদার আসনে অধিষ্টিত। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসলে সমগ্র বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পৃথিবীর দেশে দেশে যখন দিবসটি পালন হয় এবং প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয় তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। কেননা, এই দিবেসের মূলে যে রয়েছ আমাদের প্রাণের বর্ণমালা। দিনটিতে বিভিন্ন জাতি নিজস্ব মাতৃভাষার কথা আলোচনা করলেও অবধারিতভাবে প্রথমেই উঠে আসে বাংলার নাম। এই বাংলা ভাষা আমাদের ইতিহাসের মৌলিক উপাদান। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থায় বদলে গেছে মানুষের ক্রমবিকাশের ইতিহাস। বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে সমস্ত পৃথিবী এখন উন্মুক্ত, সবকিছু হাতের মুঠোয়। অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির সাথে তাল মিলাতে গিযে আমাদের স্বপ্নের তারুণ্য আজ বন্দি অ্যানড্রয়েড মোবাইলের স্ক্রিনে। তাদের অন্তরাত্মায় সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন বিশ্বসংস্কৃতির ধারা, যা আমাদের প্রজন্মকে শেকড় থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে এবং বিচ্ছিন্ন করছে আমাদের মৌলিক চিন্তা-চেতনার বিষয়গুলো থেকে। মৌলিক সংস্কৃতি আর চেতনার জায়গায় যদি আঘাত করা যায় তাহলে সেই প্রজন্মকে সহজেই বদলে দেয়া যায়। আমাদের সংস্কৃতি আর পরিচয়ের মূলে কিন্তু আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষা। তাই এই ভাষার প্রতি আমাদের যে রক্তের বাঁধন, দরদ, আবেগ, অনুভূতি সেই জায়গায় আঘাত করে যদি শেকড়কে নড়বড়ে করা যায় তাহলে সহজেই আমাদেরকে উপড়ে ফেলা যাবে। আর এই উপড়ানোর পথকে সুগম করছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম! প্রযুক্তির নেশায় বুদ হয়ে এই প্রজন্ম বই পড়া ভুলে গেছে। বেশির ভাগ সময় তাদের মন আর মগজ বন্দি থাকে কম্পিউটার অথবা মোবাইল স্ক্রিনে। তরুণ প্রজন্ম বই না পড়ার কারনে ধীরে ধীরে বাংলা চর্চা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, শিক্ষিত তরুণ সমাজের বিরাট একটি অংশ শুদ্ধ করে বাংলা লিখতে বা বলতে পারে না। এটা যে শুধু তাদের দোষ তা নয়। বিষয়টির সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, নীতি নির্ধারক, সরকার এবং সর্বোপরি আমাদের মানসিক দৈন্যদশা জড়িত।
ভাষা সংগ্রামের ৭১ বছর কেটে গেলেও বাংলাভাষাকে আমরা এখনও রাষ্ট্রের সকল স্তরে, সকল বিভাগে পরিপূর্ণ ভাবে চালু করতে পারিনি। শিক্ষাঙ্গনগুলোরও একই অবস্থা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশির ভাগই ইংরেজিনির্ভর। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মাতৃভাষার ব্যবহার উপেক্ষিত হয়েই আছে অনেকটা। তবে এবছর ফেব্রুয়ারি শুরুতেই উচ্চ আদালতে বাংলায় একটি রায় দিয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করলো। বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) এক রিট মামলায় বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষকের প্রমিত বানান ও উচ্চারণে কোন দক্ষতা নেই এবং এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও কোন মাথাব্যাথা নেই। শিশুদের বিভিন্ন বইয়েও দেখা যায় ভুলে ভরা বাংলা বানান আর বাক্য। ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদ্যাপীঠ থেকে ভুল উচ্চারণ ও ভুল বানানে মাতৃভাষা শিখছে। তার উপর রয়েছে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোতে ভিন্ন ভাষার সিরিয়াল ও কাটুন ছবি, যা প্রতিনিয়ত গিলছে আমাদের প্রজন্ম। আজকাল আবার অনেক মা-বাবাই সন্তানদের ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ঘরে বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি বলার চেষ্টা করছে। ফলে শিশুরা আম-কাঁঠাল বলার চাইতে ম্যাঙ্গো আর জ্যাকফ্রুট বলতেই পছন্দ করে! বাংলা ভাষা নিয়ে এই প্রজন্মের কোন মাথ্ব্যাাথা নেই। কারণ, তাদের মগজে আমরা এবং আমাদের পারিপার্শ্বিকতা এটা ঢুকিয়ে দিয়েছি যে, বাংলা ভাষা জেনে কোনো ভালো চাকরি পাওয়া যাবে না, বিদেশে বৃত্তি নিয়ে পড়তেও যাওয়া যাবে না। তরুণ প্রজন্মের লক্ষ্য হলো, কোনো রকমে পড়াশোনা শিখে ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্তে আনতে পারলেই একটি ভালো চাকরি পাওয়া যাবে বা বিদেশে পাড়ি জমানো যাবে। অথচ, বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যারা ইংরেজি ভালো ভাবে না শিখেও নিজেদের মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
আমরা অবশ্যই ইংরেজি সহ অন্য ভাষা শিখবো এবং চলমান সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করব তবে আপন অস্তিত্ব বিলীন করে নয়। আমাদেরকে সব সময় বায়ান্নের একুশ আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখেই পথ চলতে হবে অন্যথায় আমরা অস্তিত্ব সংকটে পতিত হব। রাস্তায় বের হলে দেখা যায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক ইংরেজিতে অথবা বাংলায় হলেও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। আবার কতেক জায়গায় বাংলায় লিখলেও বানান ভুলের কারনে অত্যন্ত আপত্তিকর বা হাস্যকর দেখায়। দেশীয় বিভিন্ন পণ্যের নামও ইংরেজিতে, এমনকি ঝাল মুড়ি কিংবা ঐতিহ্যবাহী চনাচুরের নামও ইংরেজিতে না লিখলে যেন মুখে স্বাদ লাগে না! এই হলো আমাদের মাতৃভাষার প্রতি প্রেম! আমাদের তরুণ প্রজন্ম এসব দেখেই বড় হচ্ছে, এসব থেকেই তো শিখছে। অভিভাবকগণও সব সময় চায় তাদের সন্তান শুদ্ধ করে বাংলা বলতে বা লিখতে পারুক না পারুক, যেন ইংরেজিটা শিখে। যাদের ছেলে-মেয়ে ইংরেজি জানে তারা তো এমন ভাব দেখায় যেন তাদের সন্তান মহাকাশ জয় করেছে! এই মানসিকতা পরিহার করতে হবে নতুবা নতুন প্রজন্ম কখনো মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহী হবে না। মাতৃভাষা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হলে তাদের মনে ভাষাপ্রেম আর দেশপ্রেমকে খুব ভালো ভাবে গেঁথে দিতে হবে। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত, বিচার ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিক্ষার সকল স্তরে যে সমস্ত পাঠ্যবই বাংলায় অনুবাদ করা যায় তা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আলাদা মূল্যায়নের মানসিকতা পরিহার করে শিক্ষাব্যবস্থায় একটি বৈষম্যহীন সর্বজনীন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রমিত উচ্চারণ ও বানানের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে।
যারা বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করে, সাহিত্য চর্চা করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করছে তাদের উপযুক্ত সম্মান ও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের মধ্য মাতৃভাষাপ্রীতিকে আরো কীভাবে সুসংহত করা যায়, ভাষার প্রতি তাদের অনীহার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে উপযুক্ত ও ফলপ্রসু ব্যবস্থা নেয়া না গেলে এই প্রজন্ম বাংলা, ইংরেজি, হিন্দির মিশ্রনে এক হযবরল(!) ভাষা নিয়ে বড় হবে, যা দেশ ও জাতির জন্য বড়ই অপমান ও আক্ষেপের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও আমাদের মাতৃভাষা নিয়ে আমরা যতটুকু আত্মতৃপ্তিতে ভুগি ততটুকু আত্মোপলব্ধি কি আমাদের আছে? যদি থাকতো তাহলে বাংলা চর্চার জায়গাটা এত নড়বড়ে হতো না। আমরা নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে তুচ্ছ করে হেটে চলেছি অন্য রথে। ফলে আমাদের ভাষা ক্রমশ বিকৃত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে করে তুলছে জনবিচ্ছিন্ন আর সংস্কৃতি দূষিত হয়ে ঐতিহ্যক করছে বিপন্ন। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের মানসিকতা আর প্রজন্মের কী অবস্থা তা ভবানী প্রসাদ মজুমদারের একটি ছড়ায় বেশ পরিহাসের সাথেই ফুটে উঠেছে। ছড়াটির কয়েকটি লাইন এরকম: ‘বাংলা যেন কেমন-কেমন, খুউব দুর্বল প্যানপ্যানে/ শুনলে বেশি গা জ্ব’লে যায়, একঘেয়ে আর ঘ্যানঘ্যানে।/ কীসের গরব? কীসের আশা?/ আর চলে না বাংলা ভাষা/ কবে যেন হয় ‘বেঙ্গলি ডে’, ফেব্রুয়ারি মাসে না?/ জানেন দাদা, আমার ছেলের, বাংলাটা ঠিক আসে না।’
রক্তের উষ্ণ ¯্রােতধারায় বয়ে আসা প্রিয় মাতৃভাষাকে শুধু ফেব্রুয়ারি মাস আসলেই স্মরণ করলে চলবে না। মাতৃভাষার প্রতি দরদটুকু সারাবছর সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান থাকতে হবে। হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এর বুনিয়াদকে মজবুত ভাবে গেঁথে দিতে হবে। মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ এবং পরিচর্যা আরো সুগভীর ও ব্যাপক হতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।