Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে

মুনশী আবদুল মাননান | প্রকাশের সময় : ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০১ এএম

সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় এ সম্পর্কে তার সরকারের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডসহ ১১টি শিক্ষা বোর্ডের ২০২২ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, সরকার মাদরাসা শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ইতোমধ্যে আমরা অনেক মাদরাসা এমপিওভুক্ত করে দিয়েছি। শিক্ষকদের সরকারি চাকরির সুযোগ সৃষ্ট করে দিয়েছি। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তি শিক্ষার গুরুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের উৎসাহিত করা দরকার। এতে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।

মাদরাসা শিক্ষার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অনুরাগের কথা ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই। তিনি মাদরাসা শিক্ষার সত্যিকার উন্নয়ন ও বিকাশ চান। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সর্বদা মঙ্গল ও কল্যাণ কামনা করেন। তার সরকারের সময়ে মাদরাসা শিক্ষার জন্য যা কিছু করা হয়েছে, যা কিছু করা হয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য, তা তার ইচ্ছা ও ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার প্রতি তার এই আলাদা প্রশ্রয় ও পক্ষপাতিত্বের বিবিধ কারণ থাকতে পারে। আমাদের অজানা নেই, মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা। এক সময় এটাই ছিল শিক্ষার মূলধারা। তখন মাদরাসা থেকে আলেম-ওলামা, ইসলামী বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি-সাহিত্যিক, রাষ্ট্রচিন্তক প্রভৃতি বেরিয়ে আসতো। তারা প্রতেক্যেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে যথাযথ অবদান রেখে সমাজ-সভ্যতাকে এগিয়ে নিতো। পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভক্ত ও বিশেষায়িত হয়ে পড়ায় বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও শিক্ষার বিকাশ-বিস্তার ঘটেছে। শিক্ষার ধারা বিভিন্ন ও আলাদা হয়ে গেছে। চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি, বিজ্ঞান প্রভৃতির জন্য পৃথক শিক্ষাধারা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। মাদরাসা শিক্ষা এখন মূলত দ্বীনী তথা আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ তৈরীর শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। দেশ ও সমাজে যেমন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী ইত্যাদির প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞ। দেশ ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন প্রশ্নাতীত। দেশের প্রধান রাজনীতিক দলের শীর্ষতম নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও প্রতিষ্ঠা তিনি না চেয়ে পারেন না।

দ্বিতীয়ত, তিনি ধর্মশাসিত একটি বিখ্যাত ও ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তার পূর্বপুরুষ প্রায় তিনশ’ বছর আগে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে এদেশে আসে এবং গোপালগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমাম-িত টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সঙ্গতকারণেই পরিবারের পরম্পরা অনুযায়ী, এর সদস্যরা ইসলামী শিক্ষার অনুরাগী, পৃষ্ঠপোষক ও শিক্ষিত। পরিবারেই ধর্ম শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধর্মানুরাগী। নামাজ-রোজা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিপালন করে থাকেন। তার পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ধর্মানুরাগী, ধর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে যেমন গর্ববোধ করতেন, তেমনি মুসলামান হিসেবে পরিচয় দিতেও। সবচেয়ে বড় কথা, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুই দেশে মাদরাসা শিক্ষা পুনঃ চালু করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। মাদরাসাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর ধীরে ধীরে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। বাদ থাকে মক্তব, মাদরাসা, হেফজখানা ও এতিমখানা। কোথাও কোথাও মাদরাসা ভবন বেদখল হয়ে যায়। ঢাকার আলিয়া মাদরাসার ভবনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর ক্যাম্প অফিস হয়। এর ছাত্রনিবাস বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের ছাত্রীনিবাসে পরিণত হয়। অন্যান্য মাদরাসার অবস্থাও ভিন্নতর ছিল না। মাদরাসা আদৌ চালু হবে কিনা, এ নিয়ে জনমনে দেখা দেয় ঘোর সংশয় ও অনিশ্চয়তা। ওদিকে পত্রপত্রিকার এক শ্রেণির লেখক-বুদ্ধিজীবী মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বিষোদগার করে তা বন্ধ ঘোষণার দাবিতে জোর লেখালেখি শুরু করেন। এ অবস্থায় মাদরাসা শিক্ষা রক্ষায় এগিয়ে আসেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশসহ কয়েকজন আলেম। বন্ধবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে এলে তারা এ বিষয়ে বন্ধবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু সব শুনে অবিলম্বে সব মাদরাসা খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন এবং আগের মতোই মাদরাসাগুলোতে সরকারি অনুদান দিতে আদেশ প্রদান করেন। তার এই নির্দেশে মাদরাসা ও মাদরাসা শিক্ষার ওপর থেকে কালোমেঘ কেটে যায়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান আমলের ইসলামিক একাডেমীর ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু ওই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করেন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনে রূপান্তরিত করেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৭৩ সালে প্রথম ঈদে মিল্লাদুন্নবী (সা.) অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন। বঙ্গবন্ধুই রেডিও-টেলিভিশনে পবিত্র কোরআন তেলয়াত পুনরায় চালু করেন এবং তারই নির্দেশনা অনুযায়ী রেডিওতে আরবী অনুষ্ঠান চালু হয়।

এহেন পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ইসলামের প্রতি অনুরাগী হবেন না, মাদরাসা শিক্ষার বিকাশ ও সুরক্ষায় ব্রতী হবেন না কিংবা ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ বিস্তারে উদ্যাগী ভূমিকা নেবেন না, তাহলে কে নেবে? শেখ হাসিনা বহু মাদরাসাই এমপিওভুক্ত করেননি, মাদরাসা শিক্ষকদের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধাই দেননি, মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, মাদরাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি ও মানোন্নয়ন করেছেন। শতাব্দীকালের প্রত্যাশা ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাতীয় মসজিদের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বৃদ্ধি এবং আরো মসজিদের উন্নয়ন সাধন করেছেন। বহু মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এবং বিদ্বৎজনেরা উপলদ্ধি ও অবলোকন করেছেন, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা ন¤্র ও বিনয়ী স্বভাবেরই নয়, শিক্ষার্থী হিসেবেও অত্যন্ত মেধাবী। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের তুলনায় তাদের সুযোগ-সুবিধা কম হলেও তাদের পরীক্ষার ফলাফল অনেক ভালো। বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের মেধা তালিকায় প্রথম দিকে স্থান পাওয়া তাদের মেধা ও কৃতিত্বেরই পরিচয় বহন করে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফলেও দেখা গেছে, সাধারণ শিক্ষাবোর্ড ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের তুলনায় মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের ফলাফল ভালো হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের পাসের হার ৯২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এটাই সর্বোচ্চ পাসের হার। কর্মক্ষেত্রেও মাদরাসাশিক্ষিতরা তুলনামূলকভাবে অধিকতর সৎ, দায়িত্বশীল ও কর্তব্যপরায়ণ। সবচেয়ে লক্ষনীয়, তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কম। দেশের সর্বত্র যখন দুর্নীতির সয়লাব বয়ে যাচ্ছে, তখন মাদরাসা শিক্ষিতরা দুর্নীতি থেকে প্রায় সর্বাংশে মুক্ত। ইসলামে শিক্ষার চেয়ে দীক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। শিক্ষার কোনোই গুরুত্ব ও মূল্য নেই, যদি শিক্ষার্থী তার জীবনে তা বাস্তবায়ন না করে। শিক্ষার ফল তখনই পাওয়া যায়, যখন তা জীবনে-কর্মক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হয়। ইসলাম নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের শিক্ষা দেয়। ফলে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা স্বভাবতই সত্য, ভালো ও ন্যায়ের বাইরে যেতে পারে না। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে আছে ‘আলেমরাই আল্লাহকে ভয় করে’। সূরা ফাতির, ২৮। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, মাদরাসা শিক্ষার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আল্লাহভীতি শিক্ষা দেয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। আর কেউ যদি আল্লাহভীতির শিক্ষায় শিক্ষিত হয় বা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে, তবে তার পক্ষে খারাপ বা মন্দ কিছু করা সম্ভব নয়। মাদরাসাশিক্ষিতরা তুলনামূলকভাবে অধিকতর চরিত্রবান ও দুর্নীতিমুক্ত, সেটা এ কারণেই। আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার ভয় তাদের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তাচার, অন্যায় ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। যে কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপরিচালকের মাদরাসা শিক্ষা পছন্দ করার এটা অন্যতম কারণ হওয়া উচিত ও স্বাভাবিক।

চতুর্থত, একসময় ইসলামবিদ্বেষীদের জোর প্রচারণা ছিল, মাদরাসাগুলো ‘জঙ্গীবাদের আখড়া’। এখানে জঙ্গী মতবাদ শিক্ষা দেওয়া হয়। জঙ্গীবাদের বিস্তার ও প্রসার মাদরাসা থেকেই হচ্ছে। এসব ছিল মিথ্যাচার এবং সা¤্রাজ্যবাদীদের অপপ্রচারণা। জঙ্গীবাদী বা সন্ত্রাসমূলক যত ঘটনা এ দেশে ঘটেছে, তার কোনো একটির সঙ্গেও মাদরাসা বা মাদরাসাশিক্ষার্থীর সংস্পর্শ খুঁজে পাওয়া যায়নি। হোলি আর্টিজেনের ঘটনা একটি বড় সন্ত্রাসী ঘটনা। এর সঙ্গে কোনো মাদরাসা বা মাদরাসাশিক্ষার্থী জড়িত বলে প্রমাণিত হয়নি। পক্ষান্তরে প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই ধর্মীয় শিক্ষাবঞ্চিত সাধারণ বা ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিতদের জড়িত থাকতে দেখা গেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিতরা বেশি সজ্জন, দেশ, সমাজ ও মানুষের জন্য অধিকতর নিরাপদ। এও স্মরণ করা দরকার, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে এদেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও মাদরাসাশিক্ষার্থীরাই সব সময় সোচ্চর। জঙ্গীবাদ মোকাবিলায় তাদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যদি মাদরাসা শিক্ষাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকে, তবে সেটা স্বাভাবিক ও সঙ্গত নয় কি?

জাতীয় ও সমাজ জীবনে ইসলামী ও মাদরাসা শিক্ষার যতই ইতিবাচক ভূমিকা থাকুক না কেন এবং সরকার যতই এ শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিক না কেন, আমাদের দেশে, আরো স্পষ্ট করে বললে, সরকারের মধ্যেই একটি এমন মহল রয়েছে, যারা ইসলামি শিক্ষা ও মাদরাসার প্রতি চরম বীতশ্রদ্ধ। মহলটি দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইসলামী শিক্ষা ও মাদরাসা শিক্ষার বিরুদ্ধে লাগাতার ষড়যন্ত্র করে আসছে। ইতোমধ্যে মহলটি অনেকখানি সফলতাও অর্জন করেছে। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানদের এই দেশে ইসলামবিদ্বেষী অপসংস্কৃতির চেতনাধারী এই মহলটি এখানে নাস্তিক্যবাদ ও ভারতের মোদিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। চায় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ঈমান-আকিদা, কৃষ্টি-কালচার ও ধর্মীয় চেতনা উঠিয়ে দিতে। ভারতের মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে সেখানকার সরকার যা করছে, এখানেও তাই করা হচ্ছে। ভারতের মতো এখানেও মাদরাসা শিক্ষার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত করে সাধারণ শিক্ষার অনুরূপ করার চেষ্টে চলছে।

আমাদের দেশে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা এক সময় আবশ্যিক বিষয় ছিল। স্কুলের ১০ম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষায় এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হতো। এখন তা বাদ দেয়া হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত না হলে সে বিষয়ে পাঠের আগ্রহ শিক্ষার্থীদের থাকার কথা নয়। এ ক্ষেত্রেও তা প্রমাণিত। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ইতোমধ্যে তলানিতে এসে উপনীত হয়েছে। এভাবে কৌশলে ধর্মশিক্ষা বা ধর্মীয় শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অপর্কীতি হিসেবে সিলেবাসে আনা হয়েছে ব্যাপক পরিবর্তন। সেখানে নাস্তিক্যবাদী ও পৌত্তলিক ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর ২০২৩ সালের জন্য প্রণীত ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের দুটি বই নিয়ে তুমুল বিরোধিতা হয়েছে বিভিন্ন মহলে। মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের বৃহত্তম অরাজনৈতিক সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীনসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠন, আলেম-ওলামা থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বই দুটির কটেন্ট নিয়ে প্রতিবাদ ও সমালোচনা করেছে। ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রাজনৈতিক দলগুলোও। ডারউইনের বিবর্তনবাদ, গুগল থেকে চুরি, ভুল অনুবাদ, উলঙ্গ, অর্ধ-উলঙ্গ মূর্তির ছবি, মুসলিম শাসনের বিকৃত ইতিহাস, হিন্দু শাসনের প্রশংসা, কৌশলে সমকামিতার প্রশ্রয় ইত্যাদি বই দুটিতে স্থান পেয়েছে। দেশব্যাপী ব্যাপক বিক্ষোভ-বিরোধিতার মুখে শেষ পর্যন্ত বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। সঙ্গতকারণেই অনুমান করা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই বই দুটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অবশ্য বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়ার পূর্ব পর্যন্ত ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছেন। তাই, তিনি বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা যে বই দুটি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেননি, সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

স্কুল পর্যায়ের সিলেবাসেই যে ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতিবিরেধী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাই নয়, মাদরাসার সিলেবাসেও অনুরূপ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদরাসায় ইসলামী বইয়ের সংখ্যা কমিয়ে অন্যান্য বিষয়ের বই এমনভাবে বাড়ানো হয়েছে, যাতে মাদরাসার বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণীতে বইয়ের সংখ্যা সর্বমোট ১৪টি। এর মধ্যে ৪টি বই ইসলামী, বাকি ১০টি বই সাধারণ বিষয়ের। এমন এক সময় আসতে পারে, যখন স্কুল ও মাদরাসার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এভাবে দেশ থেকে ইসলামী ও ধর্মীয় শিক্ষা বাদ হয়ে যাবে।

২০১২ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির যে বই ছাপানো হয়েছে, তার ভূমিকায় প্রধামন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের ধর্মীয় শিক্ষা দানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অথচ, বাস্তবে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় ও ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কাজ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বরাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর চেয়ে ভয়ংকর ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা আর কী হতে পারে? ইসলামী ও মাদরাসা শিক্ষাবিরোধী ষড়যন্ত্র ও অপকর্মের দায়ভাবে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের ঘাড়েই পড়বে। কাজেই, এখনই সতর্ক ও সাবধান হতে হবে। ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকেই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন