পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সরকারি-বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বছরের পর বছর ধরে ছাত্রলীগের একশ্রেণীর নেতাকর্মী নানা অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আছে। ছাত্রলীগ এতটাই প্রতাপশালী হয়ে উঠেছে যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কখনো কখনো অসহায় ও জিম্মি হয়ে পড়ে। একটি অপরাধমূলক ঘটনা ঘটানোর কিছুদিন যেতে না যেতেই আরেকটি অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। ছাত্রলীগ বরাবর এসব ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে বিচ্ছিন্ন হিসেবে গণ্য করলেও এর দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারছে না। গত রোববার কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েক দিনের মধ্যেই এক নবীন ছাত্রী ছাত্রলীগের একজন নেত্রী ও তার অনুসারীদের কথা না শোনায় চরম নিষ্ঠুরতা ও অবমাননাকর পরিস্থিতির শিকার হয়। তার ওপর চার ঘন্টা ধরে নির্যাতন চালানো হয়। অকথ্য ভাষায় গালাগাল, মারধর এমনকি বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হয়। ঘটনা কাউকে না জানানোর জন্য শাসিয়ে বলা হয়, অন্যথায় তাকে মেরে ফেলা হবে। ঘটনার দুই দিন পর তা প্রকাশিত হলে এ নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এক আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করলে গত বৃহস্পতিবার আদালত ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রদান করেছেন।
বিগত প্রায় দেড় দশক ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের একচাটিয়া আধিপত্যের জেরে একশ্রেণীর নেতাকর্মী এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠে যে, হেন কোনো অপরাধমূলক ঘটনা নাই, যা তারা করছে না। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মাদক চোরাচালান, চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, শিক্ষার্থী নির্যাতনসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আতঙ্কে পরিণত করেছে। নবীণ শিক্ষার্থীরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনন্দঘন পরিবেশের আগে চিন্তা করে ছাত্রলীগের নির্যাতনের কথা। তারা এক ধরনের ভয়ের পরিবেশের মধ্যে ভর্তি হতে বাধ্য হয়। উচ্চশিক্ষা লাভের শুরুতেই যদি আতঙ্ক পেয়ে বসে, তাহলে কোন শিক্ষার্থীর পক্ষেই সুষ্ঠু মানসিকতা ও নির্ভার হয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই মফস্বল থেকে আসে। তাদের অভিভাবকরা আর্থিক টানাপড়েনের মধ্যে কষ্টেসৃষ্টে সন্তানের শিক্ষা খরচ জোগায়। অনেক শিক্ষার্থী টিউশনি করে চলে। একধরনের হতাশা ও মানসিক চাপের মধ্যেই তাদের পড়াশোনা করতে হয়। এর মধ্যে ছাত্রলীগের আতঙ্ক তাদের দিশাহারা করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, চারপাশের হতাশা ও চাপ তাদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অথচ নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি ভয়মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা যেত, তাহলে আত্মহত্যার প্রবণতাও কমে আসত। কুষ্টিয়ায় ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ছাত্রলীগের আরও অনেক ঘটনার ধারাবাহিকতা মাত্র। গত বছর ইডেন কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতির হাতে দুই ছাত্রীর নির্যাতনের ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে। এর আগে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের ছাত্র আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এ ঘটনার কোনো প্রভাব ছাত্রলীগকে স্পর্শ করতে পারেনি। সংগঠনটি তার অপরাধমূলক ঘটনা ঘটিয়েই যাচ্ছে। গত বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, সংঘর্ষ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠনের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ১৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে। ১৭ জুলাই এক শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ব্যাপক আন্দোলন করেছিল। ছাত্রলীগের অপকর্ম এতটাই দুদর্মনীয় হয়ে উঠেছে যে, গত বৃহস্পতিবার শিক্ষাঙ্গণে ছাত্রলীগের নৈরাজ্য ও নিপীড়নের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক অধ্যাপক অনশন করেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মানবন্ধন করেছে। শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের অপকর্মের প্রতিবাদে অনশন করার মতো দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রলীগ মানেই আতঙ্কÑএমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটা ঐহিত্যবাহী এই ছাত্রসংগঠনের জন্য কোনোভাবেই সম্মানের নয়। যে ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদেরসহ আরও বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব, সেই ছাত্র সংগঠনের বছরের পর বছর ধরে নানা অপকর্ম, অপরাধমূলক ও অসম্মানজনক ঘটনায় জড়িয়ে দুর্নাম কামানো কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ছাত্রলীগের অপকর্মে বিরক্ত হয়ে একসময় এর অভিভাবকত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন। তাঁর এই অভিব্যক্তি সংগঠনটি উপলব্ধি করতে পারেনি। একের পর এক বাধাহীনভাবে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সংগঠনটি নিয়ন্ত্রণের যেন কোনো উপায় নেই। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন। এ সংগঠনের বেপরোয়া আচরণ থেকে বের করে সুনাম ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। অন্যদিকে, সংগঠনটির যেসব নেতাকর্মী অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।