পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৬ ফেব্রæয়ারি তুরস্ক এবং সিরিয়ার সীমান্ত এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্প সংগঠিত হয়। ¤’ানীয় সময় ভোর ৪.১৭ মিনিটে সংগঠিত এই ভূমিকম্পে র মাত্রা ছিল ৭.৮। মাত্র ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী এই ভূমিকম্পে মৃত্যুবরণ করেছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এবং আহত হয়েছে লক্ষাধিক। প্রায় ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন ভূমিকম্প আঘাত হানে এবং মুহূর্তেই সব কিছু লন্ডভন্ড হয়ে যায়। হাজার হাজার ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা, মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা চোখের পলকেই ভেঙ্গে পড়ে এবং সব কিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। আর এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে হাজার হাজার মানুষ, যারা নিহত এবং আহত হয়েছে। ভূমিকম্পে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে। হাইওয়ের রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় ফাটল এবং গর্ত। রাস্তা যান চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিকম্পে মারা যাওয়া মানুষগুলো সবাই আমার আপনার মতই মানুষ। ওদের মতো আগামীতে আমরাও হতে পারি বিপদগ্রস্ত। ভূমিকম্পে নিহত সবাইকে আল্লাহ তাআ’লা ক্ষমা করুন এবং জান্নাত দান করুন। যারা আহত হয়েছে আল্লাহ তাআ’লা তাদের সবাইকে দ্রæত সুস্থতা দান করুন। যারা আপনজনকে হারিয়ে এখনো বেঁচে আছেন আল্লাহ তাআ’লা তাদের স্বজন হারানোর বেদনা সহ্য করার তৌফিক দান করুন। আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের উন্নতির যুগেও মানুষ আসলে কতটা অসহায় এবং ক্ষমতাহীন তা তুরস্ক এবং সিরিয়ায় সংগঠিত ভূমিকম্পে আবারো প্রমাণ হলো। ট্যাংক, যুদ্ধ বিমান, বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্র, বোমা আর ক্ষেপণাস্ত্র, তথ্য প্রযুক্তি কোনো কিছু দিয়েই ভূমিকম্পকে প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করা যায়নি। বিজ্ঞানের কোনো আবিষ্কারই ভূমিকম্প সম্পর্কে আগাম বার্তা দিতে পারেনি, ভূমিকম্পকে স্থগিত করতে পারেনি এবং ভূমিকম্পকে প্রতিরোধও করতে পারেনি। মানুষের জীবন কতটাই তুচ্ছ, ছোট এবং অনিশ্চিত তা ভূমিকম্পে নিহত এবং আহত মানুষগুলোর দিকে তাকালে সহজেই বুঝা যায়। একটু আগের মানুষগুলো একটু পরেই শেষ হয়ে গেল।
প্রাগ ঐতিহাসিক কাল থেকে এই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে ভূমিকম্প হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। যুগে যুগে এই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অসংখ্য বার ভূমিকম্প হয়েছে। এসব ভূমিকম্পে নিহত এবং আহত হয়েছে হাজার-লাখো মানুষ। ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা, মার্কেটসহ হাজারো স্থাপনা। মাটির সাথে মিশে গেছে পাড়া, গ্রাম এবং শহর। জ্ঞানবিজ্ঞানে মানুষের অনেক উন্নতি সত্তে¡ও মানুষ কখনো এসব ভূমিকম্পের আগাম বার্তা শুনতে পায়নি, ভূমিকম্প থেকে রেহায় পেতে কোনো ধরনের প্রস্তুতি নিতে পারেনি এবং ভূমিকম্পকে প্রতিরোধ করতে পারেনি। ফলে ভূমিকম্পসমূহ তার আপন নিয়মেই সংগঠিত হয়েছে এবং তাতে মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, সহায় সম্পদ ধ্বংস হয়েছে।
এই যে নিয়মিতভাবেই ভূমিকম্প সংগঠিত হচ্ছে, তার সব কটিতেই মানুষ কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতীতে যেমন ভূমিকম্প হয়েছে, ভবিষ্যতেও তেমনি হবে। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অতীতের মতো ভূমিকম্প প্রতিরোধ এবং প্রতিহতের কোনো ক্ষমতা মানুষ ভবিষ্যতেও অর্জন করতে পারবে না। কারণ, মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানে যতই উন্নত হোক না কেন, এর একটা সীমা পরিসীমা আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের বিভিন্ন ধরনের রোগ নিরাময়ে সক্ষম, কিন্তু তাই বলে মানুষকে অমরত্ব দান কখনোই সম্ভব নয়। নারী যখন গর্ভধারণ করে, তখন একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এবং ভূমিষ্ট হবার আগে গর্ভের সন্তানটি ছেলে না মেয়ে তা পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছামত ছেলে অথবা মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়া কোনো মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। এটি আজো যেমন সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। কারণ সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সেই ক্ষমতা দেন নাই। একইভাবে জ্ঞান বিজ্ঞানে মানুষ যতই উন্নত হোক না কেন, মানুষের পক্ষে কখনোই এই পৃথিবী ছেড়ে মঙ্গল গ্রহে বা অন্য কোনো গ্রহে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করা সম্ভব নয়। কারণ, সৃষ্টিকর্তা এই পৃথিবীতেই বসবাসের জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষকে বসবাসের জন্য এই পৃথিবীকেই উপযুক্ত করে তৈরি করেছেন। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে আজ মানুষকে জানতে হবে এবং এ বিষয়ে উদাসীন থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিকর্তা সকল ক্ষমতার মালিক এবং তিনি চিরঞ্জীব। অপরদিকে মানুষ সৃষ্টিকর্তার একটি সৃষ্টি মাত্র, যার তেমন কোনো ক্ষমতাই নাই এবং মরণশীল এক প্রাণী। সুতরাং মানুষের উচিত সৃষ্টিকর্তার নিকট নিজেকে নিশর্তভাবে সম্পূর্ণভাবে সারেন্ডার করা, সৃষ্টিকর্তার উপর সর্বাবস্থায় নির্ভর করা, তারই নির্দেশিত পথে চলা এবং বিপদ-আপদ হতে রক্ষা পেতে তার কাছে সাহায্য চাওয়া।
ভূমিকম্পকে প্রতিরোধ এবং প্রতিহতের কোনো ক্ষমতা মানুষের না থাকলেও, মানুষ কিন্তু একটু চেষ্টা সাধনা করলে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারে। ভূমিকম্পের মাত্রাকে একটুখানি কমানো মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না, তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কিন্তু কমানো সম্ভব। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির প্রধান দিক হলো, বাড়ি এবং দালান-কোঠা ধসে পড়া। কম্পনের মাত্রার ওপর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে। কম্পনের মাত্রা কম হলে বাড়িঘর কম ধ্বংস হয়, ফলে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতিও তুলনামূলকভাবে কম হয়। অপরদিকে কম্পনের মাত্রা বেশি হলে বাড়িঘর বেশি ধ্বংস হয়। ফলে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতিও তুলনামূলকভাবে বেশি হয়। বাড়িঘর, বিল্ডিং, স্থাপনা দুর্বল হলে, ভূমিকম্পে তা সহজেই ভেঙ্গে পড়ে। আর অবকাঠামোগতভাবে বাড়িঘর, বিল্ডিং, স্থাপনা শক্তিশালী হলে তা সহজে ভেঙ্গে পড়ে না। বাড়িঘর, বিল্ডিং এবং স্থাপনার দুর্বলতার কারণে তুরস্কে ভূমিকম্পে বেশি পরিমাণ বাড়ি, ঘর, বিল্ডিং, স্থাপনা ভেঙ্গে চুরমার হয়েছে। এ কারণে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। সুতরাং প্রকৌশলীর পরামর্শ এবং ডিজাইন অনুসারেই বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। একই সাথে মানসম্মত পণ্য দিয়েই বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে। বিশেষ করে রড, সিমেন্ট এবং ইট-পাথর-বালি উন্নত মানের হতে হবে। তাছাড়া বিল্ডিংসহ যে কোনো স্থাপনার আশেপাশে প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত খালি জায়গা ও যান চলাচলের জন্য রাস্তা রাখতে হবে, যাতে করে ভূমিকম্পের ফলে বাড়িঘর ধসে পড়লে সেই সব খালি জায়গা ও রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে দ্রæততম সময়ে উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। আর যেখানেই ভূমিকম্প হোক, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। ভূমিকম্প সংগঠিত হলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। সবার আগে ঐক্যবদ্ধভাবে উদ্ধার কাজ চালাতে হবে, যাতে করে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষকে দ্রæত উদ্ধার করা যায়। সবাই সহযোগিতা করলে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলো আবারো বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজে পাবে এবং সুজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।